আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ০১ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি। সেই ভোর রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এখন প্রায় দুপুর হতে চলেছে। বৃষ্টি পড়ার ঝুপঝাপ শব্দের সাথে দরজা ধাক্কানোর শব্দটা বেশ বিরক্তিকর ঠেকছে চাঁদনীর কাছে। চাঁদনী নিজের ঘরে বসে আছে। দরজা ধাক্কানোর শব্দ হচ্ছে বাড়ির সদর দরজায়। অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কানোর শব্দে অতিষ্ট হয়ে চাঁদনী চিৎকার করে বললো,
"বাড়ির লোক কি সব মরেছে না কি? দরজা ধাক্কাচ্ছে কেউ, সেটা কি কানে ঢুকছে না?"
চাঁদনী চিৎকার করে বলার পরও কেউ দরজা খুললো না, আর না থামলো দরজা ধাক্কানোর শব্দ। চাঁদনীর রাগ আর ধরে না। ও হাতে থাকা পায়েসের বাটিটা ভীষণ শব্দ করে রাখলো টেবিলের উপর। ওড়নাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বেরোলো রুম থেকে। হল রুমে এসেও বাড়ির লোকদের খানিক বকা ঝকা করলো। তারপর দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললো,
"কোন অভদ্র দাঁড়িয়ে আছে দরজায়? দেখতেই পাচ্ছে দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে, তাই বলে কি দরজা ধাক্কাতে, ধাক্কাতে দরজা ভেঙ্গে ফেলবে? অভদ্র লোক দিয়েই গ্রামটা ভরে যাচ্ছে দিন দিন।"
চাঁদনী দরজা খুললো। সামনের দিকে তাকাতেই চোখ দুটো গোল গোল রূপ ধারণ করলো ওর।
"আ..." আকাশ পাতাল চিৎকার দিয়ে চাঁদনী লুটিয়ে পড়লো ফ্লোরে।
দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কর্দমাক্ত লোকটি, ফ্লোরে লুটিয়ে পড়া চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে দু বার চোখের পলক ফেললো ভাবলেশহীন ভাবে।
_______________
কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামে গুজব রটে গেল, একটা 'কাদা ভূত' ধরা পড়েছে জমিদার বাড়িতে।
যদিও বাড়িটা এখন আর জমিদার বাড়ি নেই। কোনো এক কালে ছিল। বংশ পরম্পরায় বেশ কয়েক যুগ পেরিয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে জমিদারি প্রবর্তনও বিলীন হয়ে গেছে। তবুও গ্রামের লোকজন এখনও এ বাড়িকে জমিদার বাড়ি বলেই আখ্যায়িত করে।
এই বৃষ্টি বাদলের দিনেও গ্রামের অসংখ্য উৎসুক লোক জড়ো হলো জমিদার বাড়িতে। 'কাদা ভূত' দেখতে এসেছে তারা। জমিদার বাড়ির সামনে যে বিশাল বারান্দাটা রয়েছে, সেখানে সবাইকে দাঁড়াতে বলা হলো। কাদা ভূতকে দেখতে রীতিমতো ঠেলা ঠেলি লেগে গেল।
কাদা ভূত বারান্দার এক পাশে বসে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো মানুষজনের কাণ্ড। আর মানুষজন উৎসুক ভাবে দেখতে লাগলো তাকে।
মন্টু লোকজনের উশৃঙ্খলতার জন্য গলায় বাঁশি ঝুলিয়ে হুইসল বাজাতে, বাজাতে বারান্দায় এলো। তার হাতে একটা লাঠিও দেখা গেল। মন্টু বারান্দায় এসেই লোক জনের উদ্দেশ্যে ব্যস্ত ভাবে বললো,
"দয়া করে কেউ ঠেলা-ঠেলি করবেন না। শৃঙ্খল ভাবে থাকুন। সবাই লাইন ধরে, সুশৃঙ্খল ভাবে এক জন, এক জন করে কাদা ভূত দেখুন। দয়া করে কেউ কোলাহল তৈরি করবেন না।
প্লিজ! আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, সবাই আইন মেনে চলুন।"
মন্টু এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে, কাদা ভূতের দিকে তাকালো। নম্র ভাবে বললো,
"ভূত ভায়া, এরা হচ্ছে আপনার দর্শক। দয়া করে এদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করবেন না। যদিও আপনাকে দেখে মনে হয় না যে আপনি কোনো খারাপ ব্যবহার করতে পারেন। তবুও হুঁশিয়ার করে দিলাম।"
মন্টু দাঁত বের করে হাসলো। এরপর হঠাৎ ওর চোখ পড়ল জানলার দিকে। ঝন্টুকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল। মন্টু আর ঝন্টু হলো জমজ ভাই। তবে দুজনের চেহারার খুব একটা মিল নেই। মন্টুর চেহারা হলো গোলগাল। আর ঝন্টুর চেহারা হলো একটু লম্বাটে। মানুষ সহজেই বলে দিতে পারে কে মন্টু, আর কে ঝন্টু। দুজনই এ বছর ত্রিশে পা রাখলো। মন্টু, ঝন্টুর থেকে পাঁচ মিনিটের ছোট। সবাই সময় হিসেব করে ঝন্টুকেই বড়ো বলে।
কিন্তু মন্টু সব সময় এমন ভাব করে, যেন সে ঝন্টুর থেকে ত্রিশ বছরের বড়ো।
মন্টু ঝন্টুকে ডেকে বললো,
"আরে ওই ঝন্টু, ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এখানে এসে লোক গুলোকে একটু সামলাতেও তো পারিস। এদিকে আয়।"
ঝন্টুর চেহারাটা কেমন ভীত হয়ে গেল। একটা শুকনো ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে পা ফেলে বারান্দায় এসে উপস্থিত হলো। মন্টুর কাছে আসতে, আসতে একবার কাদা ভূতের দিকে তাকালো। কাদা ভূত তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। কাদা ভূতের সাথে চোখাচোখি হতেই ভয়ে একটুখানি কেঁপে উঠলো সে।
মন্টু নিজের গলায় ঝুলিয়ে রাখা বাঁশিটা ঝন্টুর গলায় পরিয়ে দিলো। হাতের লাঠিটাও ধরিয়ে দিলো। বললো,
"এদিকটা সামলা। আমি আম্মার সাথে একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলে আসি।"
মন্টু ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। সোজা মায়ের রুমে আসলো। পারভেনু বিবি খাটের উপর বসে সোয়েটার বুনছিল। মন্টু খাটের উপর বসে বললো,
"আম্মা, আমি একটা কথা চিন্তা করছিলাম।"
"কী চিন্তা করতাছিলি বাপ?"
"ভাবলাম, আমাদের বাড়িতে তো অনেক মানুষ আসছে কাদা ভূত দেখতে। তার উপর আবার বৃষ্টি হচ্ছে। এই লোক গুলোকে খালি মুখে কীভাবে যেতে দিই? জমিদার বাড়িতে এসে এত মানুষ খালি মুখে চলে যাবে, ঠিক মানায় না। যদি একটু খিচুড়ির ব্যাবস্থা করা যেত, তাহলে ভালো হতো না?"
পারভেনু বিবির মুখটা ঝলমল করে উঠলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
"হ রে বাপ, তুই তো আমার মনের কথাডা কইয়া দিছোস। বৃষ্টির লগে খিচুড়ি, আহা! খুব ভালো হইবো। তুই তাড়াতাড়ি খিচুড়ি রান্ধনের ব্যবস্থা কর। আমি সাবেরের বউ'র লগে কথা কইতাছি।"
"আচ্ছা আম্মা।"
মন্টু খুশি মনে দৌঁড়ে চলে গেল মায়ের ঘর থেকে।
_______________
সাবের সাহেব একটু দেরি করেই উপস্থিত হলেন বারান্দায়। সাবের সাহেবই হলেন এ বাড়ির প্রধান। শুধু এ বাড়িরই প্রধান নন, পুরো গ্রামের প্রধান। লোকজন তার কথা বড্ড মানে। কোনো শালিস বসলেই তার ডাক পরে। তিনি সুষ্ঠ বিচার করেন সব কিছুর। অনেক ভেবে চিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
সাবের সাহেব ভালো করে একবার বারান্দায় চোখ বুলালো। ফ্লোরে পানি, কাঁদার মাখামাখি। সাবের সাহেব ওনার জন্য পেতে রাখা আসনে বসলেন। খুব গভীর ভাবে কিছু একটা ভেবে, ওনার থেকে একটু দূরে পাশে বসে থাকা কাদা ভূতের দিকে তাকালো। বললো,
"এই ছেলে, আমার সামনে এসে বসো।"
কাদা ভূত কিছু বললো না, নিজের জায়গা থেকে একটু নড়লোও না, শুধু কয়েকবার চোখের পলক ফেললো। যেন কিছু বোধগম্য হচ্ছে না।
ঝন্টু সাবের সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। একটু ঝুঁকে কাঁপা গলায় বললো,
"ভা-ভাইজান, এ কোনো ছেলে নয়। ভূ-ভূত। কাদা ভূত।"
সাবের সাহেব এমন আজগুবি কথা শুনে কঠিন চোখে তাকালো ঝন্টুর দিকে। ঝন্টু এমনিতেই একটু ভীতু স্বভাবের, সাবের সাহেবের এমন চাহনিতে ভয়ে জমে গেল। সম্পর্কে সাবের সাহেব ঝন্টুর বড়ো ভাই হন। সাবের সাহেব ঝন্টুর থেকে চোখ সরিয়ে কাদা ভূতের দিকে তাকিয়ে বললো,
"কি গো, আমার কথা বুঝতে পারছো না?"
কাদা ভূত এবারও কিছু বললো না, শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। সাবের সাহেব চিন্তিত ভাবে বললো,
"এই ছেলে, আমার কথা বুঝতে পারছো না? বাংলা জানো না? ভিনদেশি না কি?"
কাদা ভূত এবার চোখ নামিয়ে ফেললো সাবের সাহেবের দিক থেকে। কিছু সময় চুপচাপ বসে থেকে, মড়াটা নিয়ে সাবের সাহেবের সামনে এসে বসলো। মাথা নিচু করে রেখে বললো,
"আজ্ঞে, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। আগে বুঝতে না পারলেও, এখন বুঝতে পারছি।"
বারান্দায় উপস্থিত সবাই চমকে উঠলো। হা? কাদা ভূত কথা বলছে? এত ভালো ভাবে কথা বলছে?
সবাই আরও ভালো করে উৎসুক দৃষ্টি মেলে চাইলো। খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করে বুঝলো, আরে, এ তো কোনো ভূত নয়। মানুষ। একটা ছেলে, কাদা মাখা ছেলে। তবুও কারো উদ্দীপনার শেষ রইল না, আগের মতোই উৎসুক দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল।
সাবের সাহেবের ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠলো। বললো,
"আগে বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারছো মানে? কী বোঝাতে চাইছো এই কথা দ্বারা?"
কাদা ভূত উত্তর দিলো,
"মানে, আমি আগে বাংলা বুঝতাম না। আপনি তৃতীয় বার কথা বলার পর বুঝতে পারলাম। এবং আমি নিজেও এখন বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি। ভাষাটা আয়ত্ত হয়ে গেছে আমার।"
সাবের সাহেবের ভ্রূ জোড়া আগের থেকে আরও বেশি কুঁচকে উঠলো। সে ভীষণ রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে! সাবের সাহেব ভালো করে লক্ষ্য করলো ছেলেটার দিকে। ছেলেটার পুরো শরীর কাদায় মাখা, চেহারা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, শুধু চোখ ও মুখ দেখা যাচ্ছে, পরনের শার্ট কাদায় মেখে গায়ের সাথে লেগে আছে। বাতাসে শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে কাদা। সাবের সাহেব জিজ্ঞেস করলো,
"নাম কী তোমার? থাকো কোথায়? বাড়ি ঘর আছে?"
ছেলেটা ফের মাথা নিচু করে ফেললো। বললো,
"কিছু মনে পড়ছে না।"
"কাদা মেখেছো কোত্থেকে?"
"রাস্তার পাশে ধানের বীজ লাগানো ক্ষেতে লুটোপুটি খেয়ে উঠলাম।"
সাবের সাহেব গভীর ভাবনায় পড়ে গেলেন। ভাবতে লাগলেন, ভীষণ ভাবতে লাগলেন।
মন্টু আসলো বারান্দায়। বললো,
"যারা কাদা ভূত দেখতে এসেছেন, তারা কেউ চলে যাবেন না। সবার জন্য খিচুড়ি বসিয়েছি, সবাই খেয়ে যাবেন। কী বলেন ভূত ভাই?"
সাবের সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,
"আহ, মন্টু! এ কোনো ভূত নয়, মানুষ। মানুষ।"
মন্টু ফিক করে হেসে দিলো। বললো,
"সে তো আমি প্রথম থেকেই জানি, ইনি কোনো ভূত টুত নন। ইনি হলেন মানুষ। তবুও ওনাকে ভূত ভাই ডাকতে আমার বেশ ভালো লাগে। যেহেতু, প্রথমেই ওনার নামে কাদা ভূত সিলটা লেগে গেল, সেহেতু ওনার এই সম্মাননা ধরে রাখা উচিত না? আপনি চিন্তা করবেন না ভূত ভায়া। আমি আপনার জন্য কাঠের একটা এওয়ার্ড বানাবো। সেটাতে খোদাই করে লেখা থাকবে, 'কাদা ভূত'। তার উপরে আবার একটা কঙ্কালের মাথা খোদাই করবো। কী বলেন দারুণ হবে না?"
কাদা ভূত হাসলো। মন্টুও হাসতে হাসতে চলে গেল।
জানালা দিয়ে একজন নারী মূর্তি উঁকি দিলো বারান্দায়। তার উৎসুক চোখ কাদা ভূতের উপর। কাদা ভূত হঠাৎ তাকালো সেই জানালার দিকে। সাথে সাথে নারী মূর্তিটা লুকিয়ে পড়লো দেয়ালের আড়ালে।
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ০২ (Bangla golpo ashare dekha hobe)
লেখা: ইফরাত মিলি
হেলেনা বেগম ছোট ছেলের রুমে আসলেন। ছেলে তার টেবিলের উপর বসে কী একটা লিখেই চলেছে নোটবুকে। হেলেনা ওয়ার্ডোব খুঁজতে, খুঁজতে জিজ্ঞেস করলো,
"তোর সবুজ রঙের টি-শার্টটা কই রে, সাব্বির?"
সাব্বির লিখতে লিখতেই বললো,
"আমার টি-শার্ট দিয়ে কী করবে? সেটা তো ময়লা হয়নি। ধুয়ে দেওয়ার দরকার নেই।"
"আমি ধুয়ে দেওয়ার জন্য তোর টি-শার্ট খুঁজছি না।"
"তাহলে কিসের জন্য খুঁজছো?"
"একজনকে পরাবো।"
"কাকে পরাবে?"
"কাদা ভূতকে।"
"কাদা ভূত কে, মা?"
হেলেনা অবিশ্বাস্য ভাবে ছেলের দিকে তাকালো।
"তুই কি এই বাড়ির ছেলে? না কি বাইরের ছেলে? বাড়িতে এত কিছু হয়ে গেল, অথচ কিছুই টের পাসনি। এখন জিজ্ঞেস করছিস কাদা ভূত কে!"
কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ পেল হেলেনার কণ্ঠে।
"একেবারে যে টের পাইনি তা নয়। ঝন্টু কাকা বলে গিয়েছিল একটা কাদা ভূত ধরা পড়েছে।"
"ঝন্টু বলে যাওয়ার পরও একবার বাইরে বেরিয়ে দেখলি না? যেখানে গ্রামের সব লোক উপস্থিত হলো কাদা ভূত দেখতে, সেখানে তুই বাড়ির ছেলে হয়েও দেখতে গেলি না!"
"দেখার কী আছে, মা? ভূত বলতে কি কিছু আছে? শুধু শুধু মিথ্যা ভূত দেখে লাভ কী?"
"না তাতে লাভ থাকবে কেন! লাভ তো আছে সব তোমার লেখা-লেখিতে। তা কী মহাভারত লিখে উদ্ধার করেছো, যার জন্য একবার বাইরেও বের হওনি?"
"সেদিন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম না? তখন নোটবুক নিতে মনে ছিল না। এমনি কাগজেই কয়েকটা কবিতা লিখেছিলাম। সেগুলোই এখন নোটবুকে উঠিয়ে নিচ্ছি।"
"হুম, বুঝতে পেরেছি। তা এখন দয়া করে বলেন আপনার টি-শার্টটা কোথায়, আমি নিয়ে যাই।"
"ব্যাগের ভিতর আছে হয়তো। ঘুরতে যাওয়ার সময় সাথে নিয়েছিলাম। পরে আর বের করা হয়নি।"
হেলেনা ওয়ার্ডোব থেকে একটা ট্রাউজার নিয়ে, খাটের নিচ থেকে একটা ব্যাগ বের করলেন। টি-শার্টটা পেলেন। হেলেনা শার্ট নিয়ে যখন চলে যাবেন, তখন সাব্বির প্রথম মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
"আচ্ছা মা, নকল কাদা ভূতটা কেমন? উনি কি কাদায় মাখা? সে জন্যই কি সবাই কাদা ভূত বলছে?"
হেলেনা ছেলের কথার জবাব না দিয়েই চলে গেলেন।
_______________
কাদা ভূতকে গোসল করানোর দায়িত্ব পড়লো মন্টুর উপর। মন্টু সাথে এসিস্ট্যান্ট হিসেবে ঝন্টুকেও নিলো। বৃষ্টি এখন থেমে গেছে। কিন্তু আকাশের মুখ এখনও ভার। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ পর আবারও ঝুম বৃষ্টি হবে। মন্টু কাদা ভূতকে নিয়ে পিছনের পুকুরে এলো। পুকুরটা বিশাল, ঘাট বাঁধানো। মন্টু কাদা ভূতকে একেবারে পানি ছুঁই ছুঁই সিঁড়ির ধাপটার উপর বসালো। ঝন্টু একটা বালতি, সাবানের কেস রাখলো সিঁড়ির উপর। মন্টু এক বালতি পানি উঠালো পুকুর থেকে। টের পেল পানি ভীষণ ঠাণ্ডা। মন্টু বালতি ভরা পানি ঢেলে দিলো কাদা ভূতের উপর। দাঁত কপাটি বের করে হেসে বললো,
"কি ঠান্ডা লাগছে?"
"না ঠাণ্ডা লাগছে না। ঠিকই আছে।"
"তাহলে তো বলতে হয় আপনার লোহার শরীর। তবে আজকে আমার গরম পানি ছাড়া একেবারেই চলবে না। অবশ্য আপনি যেভাবে কাদা মাখছেন, তাতে আপনারে গোসল করাইতে, করাইতে আমার নিজেরও গোসল করা হয়ে যাবে।"
কাদা ভূত হাসলো।
কাদা ভূতকে গোসল করাতে করাতে অনেক দেরি হলো। এখন আর সে কাদা ভূত নেই, একজন মানুষ রূপেই আছে। চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চেহারা গোলগাল। গায়ের রং শ্যামলা, চোখ দুটো বেশি বড়োও না আবার বেশি ছোটও না, ঠিকঠাকই আছে। চুলগুলো কুচকুচে কালো আর একটু বড়ো বড়ো। মন্টু তো কাঁদা ভূতকে এই রূপে দেখেই বলে ফেললো,
"বাহ! বাহ! ভূত ভাই, আপনিতো দেখতে খুবই সুন্দর। শুধু শুধু কাদা ভূত খেতাব পেলেন।"
কাদা ভূত শুধু হাসলো।
বাড়ির পাশ ধরে সাবধানে ঘাসের উপর পা ফেলে ওরা বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলো। বাড়ির সামনে দুটো কদম গাছ। বর্ষার অসংখ্য কদম ফুঁটে আছে তাতে।
এছাড়াও আছে, বেলি ফুল, হাস্নাহেনা ফুল আরও কয়েকটা ফুল গাছ। বৃষ্টি আর বাতাসে ফুল গাছের তলায় পড়ে আছে ঝরে পড়া ফুল। ফুলের গন্ধে চারিদিকটা মো মো করছে। বারান্দার দু পাশে লাগানো কয়েকটা গোলাপ ফুলের গাছ, আর জবা ফুলের গাছ। কাদা ভূত মুগ্ধ নয়নে দেখলো সব ফুল। কিন্তু সে একটা ফুলও চিনতে পারলো না। এর আগে কখনো এ ফুল দেখেছে কি না মনে পড়ছে না। তবে গোলাপ ফুল গুলো একটু চেনা চেনা ঠেকলো।
কাদা ভূতকে গোসল করাতে গিয়ে মন্টুও ভিজে একাকার হয়ে গেছে। গা বেয়ে পানি পড়ছে চুইয়ে চুইয়ে। তিন জন ঘরের ভিতরে ঢুকলো। হলরুমে পা রাখতেই চাঁদনী তেড়ে আসলো। একেবারে কাদা ভূত থেকে সদ্য মানুষ হওয়া ব্যক্তিটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রায় চেঁচিয়ে বললো,
"কেমন মানুষ আপনি? হা? কেমন মানুষ? আল্লাহর রহমতে আর একটুর জন্য বেঁচে গেছি আমি। নইলে এতক্ষণে আমার লাশ কবরে থাকতো। এতক্ষণে বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যেত। আপনি কি এখানে মানুষ মারার পায়তারা করতে এসেছেন?"
কাদা ভূত শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল, কিছু বললো না। তার চোখ পড়লো একটা রুমের দরজার দিকে। যেখানে চাঁদনীর বড়ো বোন সানজু দাঁড়িয়ে আছে। কাদা ভূত তাকাতেই সে রুমের ভিতর ঢুকে গেল।
"কী হলো কোনো কথা বলছেন না কেন? বোবা হয়ে গেলেন না কি?" ফের চেঁচিয়ে বলে উঠলো চাঁদনী।
পাশ থেকে মন্টু বললো,
"আহ, চাঁদনী চুপ।"
মন্টু কাদা ভূতের দিকে কোমল চোখে তাকিয়ে
বললো,
"কিছু মনে করবেন না, ভূত ভাই।"
তারপর আবার চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললো,
"চাঁদনী, তোকে কি আমরা এই শিক্ষা দিয়েছি? সব সময় লিখিয়ে, পড়িয়ে শিখিয়েছি কোনো অথিতির সাথে খারাপ আচরণ করবি না। সব সময় নম্র কণ্ঠে, হেসে হেসে কথা বলবি। কি শিখাইনি?"
"হ্যাঁ শিখিয়েছ। কিন্তু মন্টু কাকা তুমিই বলো, এই লোকটা কাদা মেখে যেরকম ভূত সেজেছিল, তাতে কি আমার মতো একটা ছোট মেয়ে শকে মারা যেতে পারতো না? অবশ্যই পারতো।"
চাঁদনী মন্টুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবার কাদা ভূতের দিকে তাকিয়ে বললো,
"আপনি জানেন আপনাকে ভূত বেশে দেখে আমি কয় ঘন্টা অজ্ঞান ছিলাম? তিন ঘন্টা...তিন ঘন্টা অজ্ঞান ছিলাম। এখন ভেবে দেখেন আমি মৃত্যু থেকে আর কতটুকুই বা দূরে ছিলাম। আমি তো মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে গিয়ে আবার ফিরে এসেছি আল্লাহর অশেষ রহমতে। কিন্তু যদি আমি মরেই যেতাম তাহলে সেই দায়ভার কে নিতো? আপনি নিতেন?"
কাদা ভূত এবার কথা বললো,
"আমি কেন নেবো? আমি তো আর আপনাকে আঘাত করে অজ্ঞান বানাইনি। আপনি নিজেই আমাকে দেখে, নিজে, নিজে অজ্ঞান হয়েছেন। কেবল আপনিই অজ্ঞান হয়েছেন আমাকে দেখে। আপনি ছাড়াও আরও অনেক লোক দেখেছে আমায় কাদা মাখা অবস্থায়। তারা কেউই তো আপনার মতো অজ্ঞান হয়নি। তাহলে আপনি মরে গেলে আমি কেন দায়ভার নিতাম? আমার তো কোনো দোষ নেই। দোষ তো আপনার। আপনি নিজেই, নিজেকে অজ্ঞান করেছেন।"
কাদা ভূতের কথা শুনে চাঁদনীর সারা শরীর রাগে জ্বলে গেল। রাগে দু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জোরে চিৎকার করে, মেঝেতে সজোরে পা দিয়ে আঘাত করে, হনহানিয়ে চলে গেল।
কাদা ভূত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেদিকে।
মন্টু ভীষণ অপমান বোধ করছে। তাদের বাড়ির অথিতির সাথে এমন আচরণ করা সত্যিই অপমান জনক। মন্টু অপরাধী কণ্ঠে বললো,
"কিছু মনে করবেন না, ভূত ভাই। ছোটো মানুষ তো, মাত্র চৌদ্দ বছর বয়স। ওর কোনো কথা মনে ধরে রাখবেন না।"
"আমি কিছু মনে করিনি। ওনার কথায় আমার একটুও খারাপ লাগেনি। উনি তো খারাপ লাগার মতো কিছু বলেনি।"
মন্টু চওড়া হাসি দিলো। আনন্দ ঘন কণ্ঠে বললো,
"ভূত ভাই, আমায় এখন গরম পানি দিয়ে গোসল করতে হবে। ভীষণ শীত করছে। আপনার সাথে গোসল সেরে পরে কথা হবে আবার। ঠিক আছে?"
মন্টু শীতে কাঁপতে কাঁপতে চলে গেল। কাদা ভূত পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ঝন্টুর দিকে তাকালো। ঝন্টু একটু হকচকিয়ে গেল, তারপর প্রায় দৌঁড়ে মন্টুর পিছন পিছন চলে যেতে লাগলো।
_______________
হেলেনা বেগম হলরুমে এসে দেখলেন একটা সুন্দর, ভদ্র মতন ছেলে বসে আছে। তার চিনতে কষ্ট হলো না কে এই ছেলে। তাছাড়া গায়ে যে সাব্বিরের টি-শার্ট আর প্যান্ট। কাদা ভূতকে দেখেই তিনি হাসি হাসি মুখে বললো,
"আরে, এ তো দেখি আমাদের কাদা ভূত মিয়া পুরো মানুষ হয়ে গেছে।"
কাদা ভূত মুচকি হাসলো। হেলেনা বললেন,
"আসো বাবা, তোমার জন্য ঠিক করা রুমটা দেখিয়ে দিই।"
হেলেনা কাদা ভূতকে একটা রুমে নিয়ে আসলেন। ঘরের মেঝেতে একটা বিছানা পাতা। পাশে একটা আলনা। আলনাতে কয়েকটা কাপড় ঝুলছে। একটা ছোট টেবিল। তার উপর একটা গ্লাস, আর জগ রাখা। একটা চেয়ারও আছে।
হেলেনা সংকোচ নিয়ে বললো,
"তোমার এখানে থাকতে সমস্যা হবে না তো? আসলে তাড়াতাড়ি সবকিছু ঘটলো তো, তাই রুমটারে ঠিকঠাক ভাবে গোছাতে পারি নাই।"
"সমস্যা নেই। আমার এখানে থাকতে সমস্যা হবে না।"
হেলেনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বললো,
"তুমি চিন্তা করো না, বাবা। আমি কয়েক দিনের মধ্যেই রুমটা ভালো ভাবে গুছিয়ে ফেলবো।"
"হেলেনা।"
বাইরে থেকে ডাক এলো সাবের সাহেবের।
হেলেনা ব্যস্ত হয়ে চলে গেল।
কাদা ভূত রুমটার উপর আরেক বার চোখ বুলিয়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। এখান থেকে বাইরের কদম গাছ দুটো ভালোভাবে দেখা যায়। গাছ দুটো এখনও বৃষ্টির পানিতে ভিজে আছে। বাতাস হতেই পাতা থেকে পানি ঝরে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা। কদম গাছের নিচে তাকাতে একটা বেঞ্চিও চোখে পড়লো। বেঞ্চিটার উপর পড়ে আছে একটা কদম। কাদা ভূত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই কদমটার দিকে। কিছুক্ষণ পরই হঠাৎ একটা হাত তুলে নিলো কদমটা। কাদা ভূত লক্ষ্য করে মানুষটার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটা।
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ০৩ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
দুপুরের খাবার খেতে বসেছে সবাই। সাবের সাহেব কাদা ভূতের খাবার ঘরে দিতে বললেন। প্রথম দিনেই অপরিচিত লোকের সাথে খেতে সংকোচ বোধ হতে পারে, তাই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হেলেনা ট্রেতে ভাত, পুকুর থেকে ধরা কাতলা মাছের সবচেয়ে বড়ো পিচ মাছ, বিভিন্ন সবজি আলাদা আলাদা করে দিলো। হেলেনা উচ্চৈঃ কণ্ঠে সানজুকে ডাক দিলো,
"সানজু! এই সানজু!"
সানজু উপস্থিত হলো খাবার রুমে। হেলেনা সানজুর দিকে ট্রে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,
"এটা গিয়ে কাদা ভূতের ঘরে দিয়ে আয়।"
সানজু চমকিত গলায় বললো,
"আমি কেন? তুমি গিয়ে দিয়ে আসো না।"
হেলেনা সানজুর হাতে ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
"আমি কীভাবে দিয়ে আসবো? এখানে সবাই খেতে বসেছে, এদিকটা দেখতে হবে না আমার? তুই গিয়ে দিয়ে আয়।"
সানজু বাধ্য হয়ে বললো,
"ঠিক আছে।"
সানজু ট্রে নিয়ে কাদা ভূতের ঘরের সামনে এলো। দরজা ভেজানো। সানজু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বললো,
"ভিতরে আছেন?"
ভিতর থেকে কাদা ভূত বললো,
"হ্যাঁ, আসুন।"
সানজু ঘরে ঢুকলো। কাদা ভূত জানলার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। সানজুকে দেখে সে একটু অবাক হলো। সানজু ট্রে'টা টেবিলে রেখে বললো,
"আপনার খাবার নিয়ে এসেছি।"
"ধন্যবাদ।"
"স্বাগত।"
সানজু চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কাদা ভূত জিজ্ঞেস করলো,
"আমি যখন কাদা মাখা অবস্থায় বারান্দায় বসে ছিলাম, তখন আপনি জানালা দিয়ে উঁকি মেরে আমাকে দেখেছিলেন, তাই না?"
সানজু দাঁড়িয়ে গেল। পিছন ফিরে বললো,
"কখন? কখন আমি আপনাকে উঁকি মেরে দেখেছি? আমি আপনাকে কখনো উঁকি মেরে দেখিনি, আপনি ভুল করছেন।"
কাদা ভূত মাথা নিচু করে হাসলো।
সানজুর চোখে সেটা ঠিকই ধরা পড়লো।
"কী ব্যাপার আপনি হাসছেন কেন? আপনার কি মনে হয়, আমি মিথ্যা বলছি?"
কাদা ভূত সানজুর প্রশ্নের উত্তর দিলো না। সানজুর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
"নাম কী আপনার?"
"আমার নাম দিয়ে কী করবেন আপনি?"
"নাম দিয়ে তো কিছু করা যায় না, এমনিই জানতে চাইছি। কী নাম আপনার?"
"সানজানা। ছোট করে সবাই সানজু ডাকে। আপনার নাম?"
"আমার কোনো নাম নেই।"
"মিথ্যা বলছেন কেন, আপনার নাম তো 'কাদা ভূত'।"
কাদা ভূত হেসে ফেললো সানজুর কথায়।
সানজু ভালো করে কাদা ভূতকে দেখে বললো,
"সত্যিই কি আপনার কোনো নাম নেই? সবারই তো একটা নাম থাকে।"
"থাকে হয়তো। আমারও হয়তো একটা নাম ছিল। কিন্তু আমার কিছুই মনে পড়ছে না।"
সানজু সন্দেহ জনক চোখে তাকিয়ে বললো,
"সত্যিই কি মনে পড়ছে না? না কি না জানার ভাণ
করছেন?"
"আপনার কী মনে হয়?"
"আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।"
কাদা ভূত কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। সানজু তার দিকেই তাকিয়ে রইল। ও বোঝার চেষ্টা করছে তার মতিগতি।
কাদা ভূত এক সময় সানজুকে অবাক করে দিয়ে বললো,
"আপনার দুই জোড়া শালিক পাখি আছে না?"
সানজু আশ্চর্য হয়ে গেল। উদ্ধিগ্ন কণ্ঠে বললো,
"আপনি কী করে জানেন? আপনি তো আমার শাকিল পাখি দেখেননি। পাখি গুলো তো আমার রুমে আছে।"
কাদা ভূত সানজুর কথার উত্তর না দিয়ে, মৃদু হেসে বললো,
"পাখিদের ওভাবে খাঁচায় আটকে রাখবেন না। ওদের কষ্ট হয়।"
"আপনি কীভাবে জানেন ওদের কষ্ট হয়? ওরা কি আপনার কাছে বলেছে?"
"হুম, বলেছে।"
"কী? পাখিরা কথা বলেছে আপনার সাথে? মাথা ঠিক আছে আপনার? পাখিরা কথা বলতে পারে না।"
"কে বলেছে পাখিরা কথা বলতে পারে না? ওরা ঠিকই কথা বলতে পারে, কিন্তু মানুষ সেটা বুঝতে পারে না, বা বোঝার চেষ্টা করে না।"
"তাহলে আপনি বুঝলেন কীভাবে? আমার পাখিরা কোনো কথাই বলতে পারে না। এমনকি ওরা যে শেখানো কথা বলবে সেরকমটাও হবে না। কারণ আমি ওদের কোনো কথা বলতেই শেখাইনি।
আর কোনো পাখি শেখানো কথা ছাড়া কিছুই বলতে পারে না। তাহলে আপনি কীভাবে কথা বললেন ওদের সাথে? কীভাবে বুঝলেন ওদের কথা?"
"পাখিদের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকবেন, ওদের ভাব ভঙ্গি মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করবেন তাহলে আপনিও বুঝতে পারবেন ওরা কী বলছে।"
"আপনি..."
"আমি কী?"
"আপনি একজন রহস্যময় ব্যক্তি। ঠিক বুঝে উঠা যায় না আপনাকে, সকল ভাবনাই গুলিয়ে ওঠে।"
সানজু আর দাঁড়ালো না। দ্রুত পা ফেলে চলে গেল।
_______________
সানজু বাবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললো,
"আব্বা আসবো?"
সাবের সাহেবের ঘরের দরজা খোলাই। উনি মেঝেতে দাবা খেলার আসর জমিয়েছে। কিন্তু সেই আসরে উনি একা। সাবের সাহেব ঘোড়ার চাল দিয়ে বললো,
"হ্যাঁ আয়।"
সানজু বাবার সামনে আসন করে বসে বললো,
"আব্বা, আমার মনে হয় ওই লোকটাকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত।"
সাবের সাহেব দাবা বোর্ডের দিকে তাকিয়েই বললো,
"কোন লোকটাকে?"
"ওই যে কাদা ভূত।"
"কেন মনে হয় তাকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত?"
"লোকটা খুবই সন্দেহজনক। কী গ্যারান্টি আছে যে, লোকটা কোনো গ্যাংয়ের সাথে জড়িত না? দেখা যাবে একদিন আমাদের সবাইকে মেরে সব টাকা পয়সা নিয়ে ভেগে গেছে। শহরের ওদিকে তো অহরহ এমন ঘটে। তুমি জানো না?"
"ব্যস এতটুকুই?"
"লোকটা ভীষণ রহস্যজনকও। আজকে যখন খাবার দিয়ে আসতে গেলাম, তখন কী বললো জানো?"
"কী বললো?"
"পাখিরা না কি ওনার সাথে কথা বলেছে! আচ্ছা, তুমিই বলো পাখিরা কি কথা বলতে পারে?"
"ছেলেটা তো ঠিকই বলেছে..."
"ঠিক বলেছে মানে?"
"পাখিরা তো কথা বলতে পারে, মা।"
"আব্বা! তুমিও তো দেখি ওই লোকটার মতো আজব কথা বলছো। ওই লোকটা কি তোমাকে বশ করেছে?"
"পাখিদের কথা বোঝার মন থাকলেই, তুই খুব সহজেই ওদের কথা বুঝতে পারবি।"
সানজু কিছুই বুঝতে পারলো না। সব মাথার উপর দিয়ে গেল। ওর ধারণা বাবার মাথায় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। সানজু বিরক্ত হয়ে বললো,
"আসলে তোমায় বশ করেছে ওই লোকটা। তোমার সাথে কথা বলতে আসাই অনর্থক।"
সানজু উঠে পড়ল মেঝে থেকে। চলে যেতে নিলেই সাবের সাহেব বললো,
"এই শোন।"
সানজু দাঁড়ালো।
"দাবা খেলবি?"
"তুমি খেলো গিয়ে। এই ঘোড়ার ডিম দাবা খেলার কোনো শখ নেই আমার।"
সানজু চলে গেল। দাবাকে ঘোড়ার ডিম বলায় সাবের সাহেবের একটু কষ্ট লাগলো। দাবা খেলার বড়ো শখ তার। কিন্তু কেউই তার সাথে দাবা খেলে না। তাকে একাই খেলতে হয়। সাবের সাহেব একা একাই দুই পক্ষের চাল চালতে শুরু করলো।
_______________
সানজু বাবার ঘর থেকে ফিরেই নিজের পাখিদের সামনে বসে পড়লো। তাকিয়ে রইল চারটা শালিকের দিকে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে পাখিদের বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু ঠিক কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
"আমি তোদের আটকে রাখছি বলে কি তোদের কষ্ট হচ্ছে?" নিজের কৌতূহল আর দমিয়ে রাখতে না পেরে বলে ফেললো সানজু।
সানজুর কথা শেষ হওয়া মাত্রই পাখি গুলো ডেকে উঠলো। সানজু কান খাড়া করে শুনলো পাখির সেই ডাক। কিন্তু পাখির মুখের কিচির মিচির শব্দ ছাড়া কিছুই ধরা পড়লো না ওর কানে। সানজু মাথাটা আর একটু নুইয়ে পাখির খাঁচার ভিতর উঁকি দিয়ে বললো,
"কী বলছিস? কিছুই তো বুঝতে পারছি না। একটু স্পষ্ট ভাবে বলতো।"
পাখি গুলো ফের কিচিরমিচির করে ডাকতে লাগলো। সানজু বিরক্তভাবে মাথা সরিয়ে নিলো খাঁচার কাছ থেকে। বিরক্ত গলায় বললো,
"ধ্যাৎ! আমি কি পাগল হয়ে গেছি? পাখি কথা বলবে কী করে? এটা আবার পরোখ করে দেখার কী আছে? ওই লোকটার মাথা তো খারাপই, সঙ্গে আমার আব্বার মাথাটাও খারাপ বানানোর প্ল্যানে আছে। কিন্তু আমি তেমন মেয়ে নই। আমি সহজে কারো কথায় ভুলি না। আমাদের মাথায় বারি দিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে পালানোর আগে, ঠিকই ওই ব্যাটাকে এই বাড়ি ছাড়া করবো। নইলে আমার নামও সানজানা ওরফে সানজু নয়।"
_______________
সন্ধ্যা হতেই আবার গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু করেছে। ক্রমে ক্রমে তার বেগ বেড়ে এখন ঝুম বৃষ্টিতে পরিণত হয়েছে। রান্না ঘরের টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার টুপটাপ শব্দ হচ্ছে। সন্ধ্যা নাগাদ বিদ্যুৎও চলে গেছে। বৃষ্টির সময় কখনো এই গ্রামে বিদ্যুৎ থাকে না। সেই নিয়ে লোকের কথার শেষ নেই। বিদ্যুৎ যেতেই কয়েক খানা গালি শুনাবে সবাই। গ্রামে কয়েকজনের বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ আছে মাত্র। এছাড়া সবার ঘরের আলোর উৎস হবে ল্যাম্প, হারিকেন। জমিদার বাড়িতে ওই ল্যাম্প আর হারিকেনের ঝামেলা নেই। সাবের সাহেব সৌরবিদ্যুৎ লাগিয়েছে ঘরে।
সেই সৌরবিদ্যুৎ এর আলোয় এখন জমিদার বাড়িটা আলোকিত আছে। কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে বলে, খুব একটা বাতি জ্বালাতে নিষেধ করেছে সাবের সাহেব।
হেলেনা সবার হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ তুলে দিয়ে পারভেনু বিবির পাশে বসলেন। চায়ের সাথে সাথে তিনি বিস্কুটও পরিবেশন করেছেন। বাড়ির সব সদস্যরা এখন হলরুমেই আছে। সানজু আর চাঁদনীর কোনো ইচ্ছা ছিল না এখানে থাকার। কিন্তু সাবের সাহেবের আদেশকে অমান্য করতে পারেনি ওরা।
পারভেনু বিবি নিজের আগ্রহ দমিয়ে রাখতে না পেরে জানতে চাইলেন,
"হ্যাঁ রে সাবের! আমগো সবাইরে এইহানে ডাকলি ক্যান? জরুরি কিছু কইবি?"
সাবের সাহেব চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিয়ে বললো,
"ভাবছি, ছেলেটার জন্য একটা নাম ঠিক করবো। ছেলেটা তো নাম মনে করতে পারছে না! বিনা নামে তো আর ডাকা যায় না। তাই আমরা একটা নাম রেখে দেওয়ার চিন্তা করছিলাম।"
কাদা ভূত মন্টুর পাশে বসে, বিস্কুটের গায়ে এক কামড় দিয়েছিল, সাবের সাহেবের কথা শুনে সেদিকে মনোনিবেশ করলো সে।
সাবের সাহেবের কথা শুনে মন্টু উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠলো,
"তাই না কি ভাইজান? ভূত ভায়ার নাম ঠিক করা হবে? তা, ভাইজান তুমি কি নাম ঠিক করে ফেলেছো? না কি আমরা পছন্দ করে নাম ঠিক করে দেবো?"
"তোরা সবাই এক একটা নাম দিবি। যার দেওয়া নামটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ হবে, সেই নাম ধরেই ডাকা হবে ও কে।"
"তাইলে তো ভূত ভাইয়ের জন্য একখানা সুন্দর নাম চূজ করতেই হবে।"
"হ্যাঁ, একটা ভালো নাম খোঁজ।"
সবাই নাম ভাবতে শুরু করলো। একটু সময়ের জন্য নীরবতা দেখা গেল হলরুম জুড়ে।
ঝন্টু প্রথমে নীরবতা ভেঙ্গে বললো,
"আ-আচ্ছা, ওনার নাম যদি 'বৃষ্টি' রাখা হয়, তাহলে কেমন হবে? উনি তো বৃষ্টিতেই এসেছিলেন, ওনার সাথে বৃষ্টি নামটা খাপ খাবে না?"
ঝন্টুর কথা শুনে মন্টু অবাক হয়ে বললো,
"কী? বৃষ্টি? আজ পর্যন্ত শুনছিস কোনো ছেলের নাম বৃষ্টি হয়? যুগ যুগ ধরে যেখানে মেয়েদের নাম হয়ে আসছে বৃষ্টি, সেখানে তুই সেটা উল্টে ছেলেদের নামে লাগাতে চাস? তুই তো পৃথিবীর ইতিহাস উল্টানোর চেষ্টা করছিস। হায়রে! কেমন মানুষ তুই? তোর তো দেখি বিবেক বুদ্ধি কিছুই নাই।"
ঝন্টু সহ সবাই মন্টুর কথায় যুক্তি খুঁজে পেল। একটা ছেলের নাম কী করে বৃষ্টি দেওয়া যায়? এটা বেমানান।
মন্টু একটু চুপ থেকে হঠাৎ এক হাত উপরে তুলে বললো,
"ভাইজান, আমি একটা নাম ঠিক করছি। নামটা যেমন সুন্দর, তেমনি সুন্দর তার মাধুর্যতা। তোমরা সবাই শুনলে বলবে, এই ছেলের সাথে এই চমৎকার নামটা ছাড়া আর কোনো নাম যায় না।"
সাব্বির উৎফুল্ল হয়ে বললো,
"তাই না কি মন্টু কাকা? কী নাম ঠিক করেছো তুমি?"
মন্টু গর্বের সাথে বললো,
"বর্ষা। তার নাম হবে 'বর্ষা'।"
সাব্বির গলায় বিস্ময় ঢেলে বললো,
"বর্ষা! এই নাম তুমি কীভাবে রাখতে পারো? ঝন্টু কাকাকে নীতিকথা শুনিয়ে, এখন নিজে এটা কী নাম ঠিক করলে?"
"এমন ভাবে বলছিস কেন? বর্ষা নামে কী ত্রুটি আছে? বৃষ্টির থেকে অনেক অনেক উন্নত নাম এই বর্ষা।"
"একটা ছেলের নাম তুমি কী করে বর্ষা রাখতে পারো? শুনেছো কখনো কোনো ছেলের নাম বর্ষা হয়েছে?"
"তা শুনবো না কেন? আমাদের গ্রামেই তো কম করে হলেও একশো বর্ষা হবে।"
"ও তাই না কি? আমাদের গ্রামে বর্ষা নামের ছেলে আছে? তা দেখাও দেখি বর্ষা নামের একটা ছেলে।"
"দেখাতে হবে? এক্ষনি দেখাচ্ছি। ওই যে..." মন্টু এই পর্যন্ত বলে থেমে গেল। ভেবে দেখলো, আচ্ছা বর্ষা নামের কোনো ছেলে কি তাদের গ্রামে আছে? মন্টু খুব করে খুঁজলো, কিন্তু বর্ষা নামের কোনো ছেলে পেল না। মেয়ে পেল অবশ্য গোটা তিনেক।
সাব্বির ভ্রু নাচিয়ে বললো,
"কী মন্টু কাকা, আছে তোমার কোনো বর্ষা নামের ছেলে?"
মন্টু দমে গেল। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিলো না। সাব্বিরকে রাগ দেখিয়ে বললো,
"বেশি ফ্যাচফ্যাচ করিস না।"
সাব্বির হাসলো।
সাবের সাহেব তার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো,
"তোরা কোনো নাম ভাবছিস?"
চাঁদনী ঝটপট করে উত্তর দিলো,
"না আমরা কোনো নাম খুঁজে পাইনি।"
মনে মনে বললো,
"যার জন্য মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম, তার জন্য নাম খুঁজবো আমি? আমি কি পাগল?"
সাব্বির বললো,
"আব্বা, আমি একটা নাম ভেবেছি। সে তো ভর দুপুরে ঝুম বৃষ্টির মাঝেই এসেছে। বৃষ্টির সাথে কোনো একটা নাম মিলিয়ে রাখলেই ভালো হবে। যেহেতু বৃষ্টি, বর্ষা মেয়েদের নাম, সেহেতু ওই ধাঁচেরই অন্য একটা নাম ভেবেছি। যেটা ছেলেদের সাথে যায়। তার নাম 'আষাঢ়' রাখলে কেমন হয়?"
পারভেনু বিবি গলা খাঁকারী দিয়ে বলে উঠলেন,
"আরে থাম তোরা। এইসব কী হ্যান ত্যান নাম বইষ্যা, বাদলা। এই গুলান কোনো নাম হইলো। আরে চেহারা সুরতের লগে মিলাইয়া নাম রাখতে হয়। এই পোলার চেহারা সুরত কত ভালো। এক্কেরে তোগোরে বাপ, দাদার মতো। আহ্ এই পোলারে এক্কেরে হের মতোই লাগে। এই পোলার নাম আমি হের নামেই রাখতে চাই। ওর নাম হইবো 'মকবুল'। সবাই ওরে মকবুল কইয়া ডাকবা।"
পারভেনু বিবির কথা শুনে হল রুমে উপস্থিত সকলে তাজ্জব বনে গেল। মন্টু কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললো,
"আম্মা, তোমার কি মাথা ঠিক আছে? আব্বার নামে তার নাম রাখতে হবে কেন? তার সাথে কি এই নাম যায়? একটা বুড়া, বুড়া নাম। ওই নামে আব্বারেই মানাইতো, ভূত ভায়াকে মানাবে না। আর একটা মরা মানুষের নাম কীভাবে রাখতে পারো?"
সাবের সাহেব এমন অবস্থা দেখে বিরক্ত হয়ে বললো,
"আরে থামো সবাই।"
সাথে সাথে সকল বিবাদ বন্ধ হলো। সাবের সাহেব ফের বললেন,
"তোমাদের কারোর দেওয়া নামই পছন্দ হয়নি। এইসব নাম থেকে একটা নামও রাখা যাবে না ছেলেটার জন্য।
এখন আমি একটা নাম দিই সেইটা শোনো। ওর নাম হবে 'শৌখিন'।"
সাবের সাহেব মূলত হলরুমে আসার আগেই এই শৌখিন নামটা ভেবে রেখেছিলেন। ওনার প্রথম যে ছেলে সন্তান হয়েছিল, সেই ছেলের নাম ছিল শৌখিন। কিন্তু ছেলেটা সাত মাস বয়সেই মারা গেল!
সাবের সাহেবের মনে হলো, শৌখিন নামটা এই ছেলেটার সাথে বড্ড মানাবে।
"অবজেকশন, ভাইজান।" এক হাত উপরে তুলে, সাবের সাহেবের কথার তীব্র প্রতিবাদ জানালো মন্টু।
"আবার কী হলো তোর?"
"আমার কিছু হয়নি, যা হওয়ার তোমাদের হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না, ভূত ভায়ার নাম ঠিক করতে সবাই কেন মরা মানুষের নাম দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। একটা সুন্দর, জীবিত, প্রাণবন্ত নামও তো ঠিক করা যেতে পারে। তা না সবাই মরা মানুষের পিছনে দৌঁড়াচ্ছে!"
সাবের সাহেব কিছু বলার জন্য সবে মুখ খুলেছিলেন, তার আগেই কাদা ভূত বললো,
"পছন্দ হয়েছে।"
সবাই তাকালো তার দিকে। সে আবার বললো,
"নামটা পছন্দ হয়েছে আমার। শৌখিন!...খুব কোমল কোমল শুনাচ্ছে নামটা। সবাই চাইলে এই নামটাই আমি নিজের নাম হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।"
সাবের সাহেব মনে একটুখানি আনন্দ অনুভব করলো।
মন্টু দমে যাওয়া গলায় বললো,
"ঠিক আছে, যার নাম তারই যখন পছন্দ হয়েছে তখন আর কী করার! সবাই শৌখিন নামেই ডাকো।
আমার অবশ্য কোনো সমস্যা নাই। আমি তো ভূত ভাই-ই ডাকবো। তবে ভূত ভাই, আপনার কিন্তু উচিত হয়নি এই নামটা গ্রহণ করা।"
সাবের সাহেব বড়ো করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
"ঠিক আছে, আজকে থেকে এর নাম আর কাদা ভূত নয়, আজ থেকে এ হলো 'শৌখিন'।"
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ০৪ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
সকালটা বড়ো মনোরম। কাল সারা রাত ধরে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির কারণে এখন সব কিছু খুব সতেজ দেখাচ্ছে। গাছ গুলো যেন বৃষ্টিতে স্নান করে পরিপূর্ন সুধা অর্জন করেছে। তাদের সৌন্দর্য যেন দ্বিগুন বেড়ে গেছে। সবথেকে সতেজ মনে হচ্ছে কদম গাছ দুটোকে। কী সুন্দর! এক ঝাঁক কদম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফেরিওয়ালার মতো। এছাড়াও বাড়ির পাশের লাউ আর কুমড়োর মাচা দুটো যেন আরও বেশি সবুজ মনে হচ্ছে। পাতাগুলো যেন এই একদিনেই অনেকখানি বড়ো হয়ে গেছে। সানজু ব্রাশ করতে করতে কদম গাছের দিকে এগিয়ে গেল। অনেক কদম ঝরে পড়েছে নিচে। সানজু সব কদম কুড়িয়ে বেঞ্চির উপর রাখলো। অন্যান্য ফুল গাছের নিচেও ফুল পড়ে থাকতে দেখলো। ভালো ফুল যা পড়েছিল সেগুলোও বেছে বেছে রাখলো কদমের সাথে। কালকে এত ঝড় বৃষ্টি যাওয়া সত্ত্বেও কোনো গাছের ক্ষতি হয়নি। সানজু খুব মজবুত করে লাগিয়েছে সব গাছ। গত বছর ঝড় বৃষ্টিতে সব ফুল গাছ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই এ বছর সব গাছ এমন ভাবে লাগিয়েছে যাতে সবকিছু সহজে ভেঙ্গে না পড়ে বা উপড়ে না পড়ে। সব গাছ ও একাই লাগিয়েছে। চাঁদনীর আবার এসব ফুল টুলের প্রতি আগ্রহ নেই। ঝন্টু কাকা অবশ্য সাহায্য করেছিল একটু।
সানজু এবার কল পাড়ে যাওয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করলো। বাড়ির পাশে টিউবওয়েল বসানো। সানজু রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে কল পাড়ে গিয়ে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দাঁত ব্রাশ করে। তারপর ঘরে এসে সকালের খাবার খেয়ে সবকিছু গুছগাছ করে রওনা হয় স্কুলের উদ্দেশ্যে। সানজু এবার ক্লাস টেনে পড়ে। চাঁদনী পড়ে নাইনে। সানজুর খুব শখ ছিল দুই বোন এক ক্লাসে পড়বে, এক বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসবে। কিন্তু সেসব আর হলো কই! চাঁদনীর থেকে প্রায় দুই বছরের বড়ো বলে মা ও কে চাঁদনীর আগেই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। সানজু একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো।
দূরে বসে কল পাড়ে শৌখিনকে দেখে সানজু আবার উল্টো হাঁটা শুরু করলো। সে এখন কিছুতেই এই লোকটার সাথে দেখা অথবা কথা বলে নিজের মন মেজাজ খারাপ করতে চায় না। সানজু পুকুরের দিকে হাঁটতে লাগলো।
হেলেনা পুকুর পাড়ে বসে জামা কাপড় ধৌত করছিলেন। তিনি ঘাটে সানজুর উপস্থিতি টের পেলেন। সাথে অবাকও হলেন। সানজু কখনো সকাল বেলা পুকুরে আসে না। সবসময় ওই কল পাড়ে বসেই দাঁত ব্রাশ করে। হেলেনা নিজের অবাক হওয়ার রেশটুকু ধরে রেখেই বললো,
"কীরে সানজু, তুই পুকুর পাড়ে আসছিস কেন? কলে কি কোনো সমস্যা হইছে?"
"সমস্যা হয়েছে না আবার, বিশাল বড়ো সমস্যা হয়েছে। এরপর থেকে তো আর কলে পা রাখতে পারবো না। আর পা যাতে না রাখতে পারি সে ব্যবস্থা তো তোমরাই করেছো।"
সানজু সিঁড়ির উপরে থাকা মগ নিয়ে পুকুর থেকে পানি উঠালো। সিঁড়ির পাশের আসনে বসে দ্রুত মুখ ধুতে লাগলো।
________________
হলরুমে অচেনা লোকদের কথাবার্তা শুনে চাঁদনী উঁকি দিলো। দরজায় পর্দা টানানো। পর্দা ফাঁক করে উঁকি দিচ্ছে। দুই জন পুলিশ বসে আছে। সাবের সাহেবের সাথে কথা বলে চলেছে তারা। মাঝে মাঝে আবার শৌখিনকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আর খাতায় কী সব লিখছে!
সানজু মুখ ধুয়ে এসে চাঁদনীকে উঁকি মারতে দেখে সে নিজেও উঁকি মারলো। পুলিশ দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেল। ছোট বেলায় পুলিশকে অনেক ভয় পেত। কিন্তু এখন তেমন একটা ভয় পায় না। তবুও হঠাৎ করে পুলিশ দেখলেই বুকটা কেমন ধক করে ওঠে।
পুলিশ আসার কারণটা যখন সে বুঝতে পারলো, তখন মনে শান্তি অনুভব করলো। তার বাবা এতদিনে একটা কাজের মতো কাজ করলো। এবার পুলিশই খুঁজে বের করবে কে এই লোক! সানজু নিশ্চিত, তদন্ত রিপোর্টে উঠে আসবে, লোকটা একটা সন্ত্রাসী দলের সদস্য।
পুলিশ সদস্যরা আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে চলে গেল।
হেলেনা এসে সানজু আর চাঁদনীকে উঁকি ঝুঁকি মারতে দেখে বললো,
"তোরা এখনও এখানে! কয়টা বাজছে খেয়াল আছে? কিছুক্ষণ পর নয়টা বাজবে। যেয়ে দেখবি প্রাইভেট পড়ানো শেষ। খেতে আয়।"
"আসছি মা।" চাঁদনী চলে গেল মায়ের পিছন পিছন।
সানজু গেল না। সে গেল বাড়ির সামনে। বেঞ্চির উপর থেকে ফুল গুলো এনে নিজের ঘরে রেখে তারপর খেতে বসবে। কিন্তু বাড়ির সামনে এসে সে যারপরনাই অবাক। একটা ফুলও নেই বেঞ্চিতে। কোথায় গেল সব ফুল? বাড়ির এমন কেউ নেই যে তার ফুল নিয়ে যাবে। তাহলে কে নিলো? কে চুরি করলো? সানজু একটু ভাবতেই বুঝতে পারলো কে নিয়েছে। পাশের বাড়ির ওই মিঠু ছেলেটাই নিয়েছে। ছেলেটা এমনই করে সব সময়। কোনো ফুল ঝরে পড়লেই এসে নিয়ে যায় চুপিচুপি। সানজু অনেক বকাবকি করেছে এর জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা! কয়েকদিন একটু নিশ্চুপ ছিল, আজকে আবার শুরু করেছে।
"আপু!" ঘরের ভিতর বসে বড়ো গলায় ডাকলো চাঁদনী।
সানজু পা বাড়ালো ঘরের দিকে।
________________
শৌখিন বাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ইটের রাস্তা। এখনও পাকা হয়নি। রাস্তায় দাঁড়ালে নজরে পড়ে দূরে ধানের বীজ লাগানো ক্ষেত। বৃষ্টির পানি জমে আছে ক্ষেতে। ঘোলাটে পানি।
একটা রিক্সা এসে থামলো শৌখিনের সামনে। রিক্সা থেকে নামলো একজন মাঝ বয়সী লোক। শৌখিন এগিয়ে গিয়ে বললো,
"কেমন আছেন, ভাই?"
"ভালো আছি, ভাই। তয় আপনে কেডা? আপনেরে তো চিনতে পারলাম না!" খানিক অবাক হয়ে বললো লোকটা।
"আমি শৌখিন। এই বাড়িতে আছি কালকে থেকে। আচ্ছা ভাই, আপনার এটা কি রিক্সা?"
লোকটা হেসে উঠলো শৌখিনের কথায়। পান খাওয়া লাল দাঁত নজরে পড়লো শৌখিনের। লোকটা হাসতে হাসতে বললো,
"আপনে কি চোহে কম দ্যাহেন? এইডা রিক্সা না তাইলে কি উড়ুজাহাজ?"
লোকটা হাসতে হাসতে ঢুকে গেল বাড়ির ভিতর।
ঘরের সামনে এসে সানজু আর চাঁদনীকে দেখলো। ওদের গায়ে স্কুলের পোশাক। লোকটা এগিয়ে এসে বললো,
"কই যাইতেছ মামনিরা? স্কুলে যাও?"
সানজু মাথা নেড়ে বললো,
"হুম রহমত চাচা, স্কুলে যাই।"
"ভালা, ভালা। লেখাপড়া কইরা অনেক বড়ো হও।"
"দোয়া করবেন চাচা।"
রহমত হঠাৎ মনে পড়ার মতো করে বললো,
"আচ্ছা, তোমগো বাড়ির সামনে একটা পোলা দেখলাম! পোলাডা কেডা?"
"উনি শৌখিন। আমাদের বাড়িতে কাদা ভূত ধরা পড়ার খবরটা তো শুনেছেন মনে হয়। উনিই হলেন সেই কাদা ভূত।" বললো চাঁদনী।
রহমত কিছুটা টেনে বললো,
"ও...হ, শুনছিলাম আমি। তয়, কাম থাহনের লাইগা আইসা দেখতে পারি নাই। আইজকা তো দেহি হে পুরাই মানুষ। এহন কও, তোমগো আব্বায় কই?"
সানজু বললো,
"আব্বা তো তৈরি হচ্ছে, দোকানে যাবে। আব্বার কাছে কী প্রয়োজনে আসছেন?"
"আরে, আমার বাড়ির পাশে যে জমিটা আছে না? খলিল কইতাছে ওই জমি না কি ওর। গ্রামের ব্যাকতে জানে ওই জমির মালিক আমি। তবুও খলিল নাছোড়বান্ধার মতো কইতাছে ওই জমি না কি ওর। সেইটা লইয়াই তোমার আব্বার লগে কথা কইতে আইছি।"
রহমত ঘরের ভিতর ঢুকে গেল। চাঁদনী, সানজু হাঁটতে শুরু করলো। বাড়ি থেকে বের হয়ে সামনে শৌখিনকে দেখেও দেখলো না তারা। কিন্তু শৌখিন আগ বাড়িয়ে ওদের পিছন থেকে ডেকে বললো,
"কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?"
দুই বোনই দাঁড়ালো। চাঁদনী বললো,
"কোথায় যাই, সেটা আপনাকে বলবো কেন? কী করবেন আমরা কোথায় যাচ্ছি শুনে?"
"আমি এমনিই জানতে চাচ্ছি।"
সানজু বলে উঠলো,
"কেন, এমনিতে জানতে চাইবেন কেন? এটা আপনার এমনিতে জানতে হবে, ওটা আপনার এমনিতে জানতে হবে! এত এমনিতে জানার আগ্রহ পান কোত্থেকে? শোনেন, আপনি কি ভাবছেন আপনার মতলব আমি জানি না? কায়দা করে কয়েক দিন আমাদের বাড়িতে থাকবেন, পরবেন, খাবেন তারপর সুযোগ বুঝে একদিন আমাদের মাথায় বারি দিয়ে, আমাদের সকল টাকা পয়সা নিয়ে ভাগবেন! কি ভাবছেন সেসব আমি জানি না? বুঝি না কিছু? শোনেন দ্রুত আমাদের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিন। সেটা আপনার জন্যই ভালো।"
সানজু কথা গুলো বলা শেষ করে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো। চাঁদনীও দাঁড়িয়ে রইল না, সেও বোনের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে লাগলো।
শৌখিন ফিরে আসলো আবার বাড়ি। কদম গাছের সামনে দাঁড়ালো এসে। তার এই কদম ফুল গুলো বেশ লাগে। এছাড়াও অনেক প্রজাতির ফুল দেখেছে সে। কিন্তু কোনো ফুলই এত ভালো লাগেনি। এই ফুল গুলো এত ভালো লাগার কারণ সে জানে না।
"ও শোকেন! ওইহানে কী করো? এইদিকে আও একটু গপ শপ করি।" বাড়ির সদর দরজায় বসে উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বললো পারভেনু বিবি।
শৌখিন কাছে আসতেই সে বললো,
"কেমন আছো, শোকেন?"
"দাদি আমার নাম তো 'শোকেন' না। শৌখিন।"
"ওই হইলোই তো, শোখেন'ই তো। তা কওছে কেমন আছো?"
"জি দাদি আমি তো ভালোই আছি।"
"ভালা থাকলেই ভালা।"
পারভেনু বিবি একটু থেমে ফের বললো,
"জানো শোকেন, তুমি দেখতে না একেবারে তোমার দাদার মতো। জুওয়ান কালে হেরে দেখতে একেবারে তোমার মতোই লাগতো। তোমার মধ্যে আমি হের ছায়া দেখতাছি।"
"কখন তার মতো লাগতো আম্মা?" পারভেনু বিবির কথায় বাগড়া দিয়ে বলে উঠলো মন্টু। সে এক জরুরি কাজে বাজারে গিয়েছিল। বাজার থেকে ফিরে মায়ের এমন কথা শুনে সে প্রতিবাদ না করে পারলো না। মন্টু আবার বললো,
"আব্বা কখন এমন ছিল আম্মা? আব্বারে দেখতে কখন তার মতো লাগতো? আমি তো আব্বারে কোনো দিনও ভূত ভায়ার মতো দেখি নাই। দুজনে তো পুরোই দু রকম।"
পারভেনু বিবি হুংকার দিয়ে বললো,
"চুপ কর রে বেয়াদব পোলা! মায়ের লগে ক্যামনে কথা কইতাছস? তোর বাপেরে আমার থেইকা কি তুই বেশি দেখছোস? তুই বেশি চিনোস?"
"তোমার থেকে বেশি না দেখলেও, দেখছি তো! আব্বায় মোটেই ভূত ভায়ার মতো ছিল না। ওসব তোমার মনের ভুল..."
মন্টু মায়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে শৌখিনকে বললো,
"চলেন ভূত ভাই, আমাদের বাড়ির পাশের কৃষি জমি থেকে একটু ঘুরে আসি। জানেন তো আমাদের এখানে ওই জায়গাকে বলা হয় 'চর'। এ বছর আল্লাহ দিলে অনেক ভালো কৃষি হইছে। লাউ, কুমড়ো, ঢেঁড়শ, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, ঝিঙা, শসা, কাঁকরোল আরও মেলা কৃষি হইছে। চলেন দেইখা আসবেন।"
মন্টু প্রায় হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল শৌখিনকে।
পারভেনু বিবি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। সে একটু শৌখিনের সাথে গল্প গুজব করতে চাইলো। আর তার ছেলে তাদের কথার মধ্যে বাম হাত ঢুকিয়ে দিলো। তার ছেলে কি না এখন ধীরে ধীরে বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে! তাকে পর্যন্ত অপমান করতে পারলো? একটু বাঁধলো না? ইশ, এই শিক্ষা দিয়ে কি উনি ওনার ছেলেদের বড়ো করেছেন?
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ০৫ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
টানা এক ঘন্টা অংক করার পর সানজু পড়ার টেবিল ছেড়ে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলো। উপরের দিকে তাকিয়ে কেবলই চোখের পলক ফেলতে লাগলো। হুট করে ওর মনে একটা আজব ইচ্ছা হলো। সানজু উঠে বসলো। মাথায় ভালো করে ওড়না টেনে দিলো। তারপর বের হলো রুম থেকে।
শৌখিনের রুমের সামনে এসে সানজু থামলো। রুমের দরজা আধ ভেজানো অবস্থায় আছে। সানজু দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো রুমের ভিতর, শৌখিন রুমে আছে কি না!
"কী করছেন, আপনি?" পিছন থেকে ভেসে এলো কারো কণ্ঠ।
সানজুর চলন্ত আঁখি দুটি স্থির হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে পিছন ফিরলো। শৌখিনকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। শৌখিন সানজুর পাশে দাঁড়িয়ে দরজায় মৃদু ঠেলা দিয়ে রুমের ভিতর ঢুকলো। সানজুকে বললো,
"ভিতরে আসেন।"
সানজু ঘটঘট করে ঢুকলো রুমের ভিতর। শৌখিন চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
"বসেন।"
তারপর নিজে গিয়ে বসলো ফ্লোরে পাতা বিছানাতে। সানজু বসলো না, দাঁড়িয়েই রইল। শৌখিন আসন করে বসে বললো,
"এখন বলুন, আমার ঘরে উঁকি মারছিলেন কেন?"
সানজু শৌখিনের প্রশ্ন উপেক্ষা করতে পারলো না। যেহেতু সে হাতে নাতে ধরা পড়েছে, সেহেতু কিছু তো একটা বলতেই হবে। সানজু বললো,
"দেখছিলাম আপনি কোনো হিসাব-নিকাশ বা দিক নির্দেশনা ঠিক করছিলেন কি না।"
শৌখিন অবাক হয়ে বললো,
"কীসের হিসাব-নিকাশ, দিক নির্দেশনা?"
"এই যেমন, কবে আমাদের মাথায় বারি দিয়ে সব টাকা পয়সা নিয়ে ভাগবেন, কোন কোন রাস্তা দিয়ে পালাবেন এই গ্রাম ছেড়ে, সেসব আরকি!"
"আপনার কেন মনে হয়, আমি আপনাদের মাথায় বারি দিয়ে, আপনাদের সব টাকা পয়সা নিয়ে ভাগবো?"
"মনে হওয়ার তো অনেক কারণ আছে। আমি কি শুনাবো সেসব কারণ? না থাক। আগে দেখি পুলিশ কী তথ্য বের করে আপনার। বুঝলেন, আপনার না আর বেশি সময় নেই এই বাড়িতে। আপনাকে লেজ গুটিয়ে দ্রুত এ বাড়ি ছাড়তে হবে। চৌদ্দ শিকের ঘরে স্থান হতে পারে আপনার। এটা আমার মন বলছে..." সানজু মুখ বাকিয়ে হাসলো। আবার বললো,
"আমি এখন যাই। আপনি শান্তিতে ঘুমান। বলা তো যায় না, কালকে থেকে হয়তো শান্তির ঘুমটা অশান্তিতেও কাটতে পারে।"
সানজু যাওয়ার জন্য কয়েক পা হেঁটে আবার থেমে গেল। দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রুমের এক পাশে দেয়াল ঘেঁষে রাখা টেবিলটার উপর। টেবিলের এক কোণে কদম সহ আরও অন্যান্য ফুল পড়ে আছে। সানজুর মনে পড়লো কদম গাছের নিচে বেঞ্চির উপর রাখা ফুল গুলো চুরি হয়ে যাওয়ার কথা। তার মানে মিঠু নেয়নি?
সানজু টেবিলের কাছে গিয়ে ছোঁ মেরে তুলে নিলো ফুল গুলো। শৌখিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
"এগুলো আপনার রুমে কেন?"
"বেঞ্চির উপর পড়ে ছিল, তাই নিয়ে এলাম।"
"এগুলো বেঞ্চির উপর পড়েছিল না। এগুলো আমি বেঞ্চির উপর রেখেছিলাম। আপনার সাহস কী করে হয় আমার ফুলের গায়ে হাত দেওয়ার? কোন সাহসে এগুলো আপনার ঘরে এনে রেখেছেন?"
"আমি তো শুধু পড়ে থাকা ফুল গুলো ঘরে এনেই রেখেছি। অথচ আপনি এমন একটা ব্যবহার করছেন, যেন আমি আপনার ফুল গাছ গোড়া সহ উপড়ে ফেলেছি।"
"বেশি পাকা পাকা কথা বলবেন না। আমি লোকের এমন পাকা পাকা কথা একদম সহ্য করতে পারি না। ফারদার আমার ফুল ছুঁয়ে দেখার সাহস করলে, আপনার হাত সুস্থ সবল থাকবে কি না সেটা নিয়ে আমার সন্দেহের কমতি নেই।"
সানজু ফুল গুলো ওড়নার আঁচলে নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
সানজু বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর হেলেনা আসলেন। একটা নকশি কাঁথা রাখলো শৌখিনের পাশে। বললেন,
"কালকে রাতে একটু শীত পড়েছিল। নিশ্চয়ই তোমার শীত করেছে! আজকে যাতে শীত না লাগে সে জন্য কাঁথা নিয়ে এলাম।"
"ধন্যবাদ।" শৌখিন সৌজন্যতা স্বরূপ বললো। সত্যি কথা বলতে শৌখিনের শীত করেনি। শীত, গরম খুব কমই অনুভব হয় তার।
হেলেনা বললেন,
"কিছুক্ষণ পর রাতের খাবার খেতে এসো খাবার রুমে।"
এই প্রথম ডাকা হলো শৌখিনকে খাওয়ার রুমে। সাবের সাহেবই ডাকতে বলেছে।
শৌখিন একটু অবাক হলো। কিন্তু তা ধরা না দিয়ে বললো,
"ঠিক আছে।"
______________
চাঁদনী কলস থেকে পানি ঢেলে জগ ভর্তি করলো। জগ টেবিলে রাখার জন্য ঘুরে সামনে তাকাতেই আঁতকে উঠলো। এতটাই ভড়কে গেল যে এক পা পিছনেই চলে এলো। চাঁদনীর থেকে একটু দূরে শৌখিন দাঁড়ানো। চাঁদনী ধীরে ধীরে শান্ত হলো। যে এক পা পিছনে গিয়েছিল, সে এক পা সামনে তেড়ে এসে মৃদু চেঁচিয়ে বললো,
"আপনি কি সাপ না কি? সাপের বেশ ধরে চলাফেরা করছেন? কোনো সাড়া শব্দ করলেন না কেন? এই দুই বার...দুই বার হলো আপনার কারণে আমি মরতে বসেছিলাম। একবার তো আপনার কারণে অজ্ঞান হয়েও ভাগ্য ক্রমে জ্ঞান ফিরে পেয়েছিলাম। এবার জ্ঞান হারালে হয়তো আর চোখ খুলতাম না, নিশ্চিত আমি মরেই যেতাম।"
"মানুষ আবার সাপ হয় কী করে?"
"হয়, মানুষ সাপ হয়। অনেকে মানুষের মতো দেখতে হলেও তাদের মনটা থাকে বিষাক্ত সাপের মতো।"
"তাহলে আপনি মনে করেন আমার মন বিষাক্ত সাপের মতো?"
"আপনার মনটা বিষাক্ত সাপের মতো কি না সেটা তো জানি না, তবে আপনার আচরণ সাপের মতো।"
"কার সাথে কথা বলছিস রে চাঁদনী?"
কথাটা বলতে বলতে খাবার ঘরে ঢুকলো সানজু।
শৌখিনকে দেখে বললো,
"ও-হো কাদা ভূতের সাথে কথা বলছিস! কী বিষয়ে কথা বলছিস? কোনো কিছু চুরি টুরি করেছে না কি?"
শৌখিন একটু হেসে বললো,
"আপনারা দুই বোনই প্রায় একই রকম!"
চাঁদনী বিস্ময় নিয়ে বললো,
"আমরা দুই বোন একই রকম কথাটা এভাবে হেসে বললেন কেন? কী বুঝাতে চাইলেন? এই কথাটা দিয়ে কি কোনো ভাবে আমাদের অপমান করার চেষ্টা করলেন?"
"আমি তো কোনো প্রকার অপমান করার চেষ্টা করিনি। কেন, আপনারা কি অপমান বোধ করছেন? আপনারা দুই বোন কি এক রকম হতে পছন্দ করেন না?"
সানজু এবার বিরক্ত হয়ে বললো,
"সব সময় আছে শুধু পাকা পাকা কথা। এই একটা যোগ্যতা নিয়েই কি জন্মেছেন?"
"আমার যোগ্যতা অনেক বেশি। সাধারণ মানুষের থেকে অনেক অনেক বেশি।"
"অ্যা? কী বললেন?"
"কিছু না।"
"আপনার সাথে কথা বলাই ভুল। কোনো সুস্থ মানুষ আপনার সাথে কথা বলে শান্তি পাবে না। পাগলরা অবশ্য শান্তি পেলে পেতেও পারে।"
সানজু এমন ভাবে কথাটা বললো যে, চাঁদনী শব্দ করে হেসে উঠলো। সানজু নিজেও হাসতে হাসতে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো। চাঁদনী বসলো সানজুর মুখোমুখি একটা চেয়ারে। শৌখিন চাঁদনীর পাশের একটা চেয়ার টেনে বসতে যাবে অমনি চাঁদনী বললো,
"এ কী! আপনি এখানে বসার সাহস কীভাবে করতে পারেন? ওই যে ওখানে সব চেয়ে কানার চেয়ারটা দেখতে পাচ্ছেন? ওই খানে বসেন গিয়ে। আপনি হলেন আমার কাছে আততায়ী ব্যক্তি (আক্রমণকারী ব্যক্তি)। আততায়ী ব্যক্তির থেকে সব সময় দূরে দূরে থাকতে হয়। দুই দুই বার প্রায় মরার পথে গিয়েছি আপনার জন্য। তৃতীয় বার যাওয়ার কোনো শখ নাই। তাই ওই খানে গিয়ে বসেন।"
শৌখিন যে চেয়ারটা টেনে বের করেছিল বসার জন্য, সেটা আবার ঠিক করে রাখলো। চাঁদনীর কথা অনুযায়ী গিয়ে সবচেয়ে কর্ণারের চেয়ারে বসলো। সানজু ভালো করে তাকিয়ে দেখলো শৌখিনকে। লোকটার কি একটু খারাপ লেগেছে? মুখের ভাব ভঙ্গি দেখে সানজু কিছুই বুঝতে পারলো না। কী যেন আছে ওই মুখে! ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। এ পর্যন্ত ওর দেখা সকল মানুষের থেকে ভিন্ন ওই মুখের হাবভাব। সানজু কিছু সময় তাকিয়ে থেকে শান্ত ভাবে প্রশ্ন করলো,
"আপনি এখানে আসছেন কেন? আপনাকে কি ডাকা হয়েছে?"
"আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার মা আসতে বলেছিলেন।"
কিছুক্ষণের ভিতর সবাই এসে উপস্থিত হলো খাবার ঘরে। মন্টু আর ঝন্টু নেই শুধু। তারা গিয়েছে এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াতে। হেলেনা সবার খাবার বেড়ে দিয়ে নিজেও বসলেন। সাব্বির, শৌখিনের অভিমুখে বসা। সাব্বির খাচ্ছে আর শৌখিনকে দেখছে। এক সময় সে বললো,
"আপনার চুল গুলো কাটতে হবে, শৌখিন ভাই। একটু বড়ো আছে।"
সাব্বিরের কথা শুনে সবাই তাকালো শৌখিনের দিকে। হ্যাঁ, চুল কিছুটা বড়ো। কপাল বেয়ে নেমে এসে চোখের পাঁপড়ি ছুঁয়ে যাচ্ছে। সাব্বির এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে আবার বললো,
"চিন্তা করবেন না ভাই, সকাল হতেই আমি আপনার চুল কেঁটে দেবো। চুল কাটায় একটু এক্সপার্ট আছি আমি। আমার এক স্কুল ক্লাসমেটের স্যালুন আছে বাজারে। ও কে দেখে দেখেই শিখেছি।"
চাঁদনী মুখ বাঁকালো। যতসব আদিখ্যেতা তার পরিবারের লোকজনের। এই লোকটাকে নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে? লোকটা যদি অত বড়ো বড়ো চুল নিয়ে স্বস্তি পায়, তাহলে থাক না ওরকম। শুধু শুধু আগ বাড়িয়ে ওগুলো কেটে দেওয়ার কী দরকার আছে?
________________
চাঁদনী খেয়ে দেয়ে বোনের সাথে বোনের রুমে এলো। ওরা দুই বোন আলাদা রুমে থাকে। সমস্যা সানজুর জন্য। সানজু না কি কারো সাথে ঘুমাতে পারে না। তার না কি পাশে কেউ থাকলে ঘুম হয় না। তাই সানজুর একার জন্য একটা আলাদা রুম দেওয়া হলো। চাঁদনীও এখন একা একটা রুমে থাকে। আগে পারভেনু বিবির সাথে ঘুমাতো। কিন্তু পারভেনু বিবিও কিছু দিন পর জানিয়ে দিলেন তার না কি বিছানার অর্ধেক জায়গায় ভালো ঘুম হয় না। তার না কি পুরো একটা বিছানাই দরকার। ব্যস, চাঁদনীর স্থান হলো তারপর থেকে একলা একটা ঘরে। প্রথম প্রথম অনেক ভয় করতো একা থাকতে। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে মানিয়ে গেছে।
সানজু জানালার দিকে এগিয়ে গেল। জানালার একটা কপাট বন্ধ অপরটি খোলা। সানজু বন্ধ কপাটি খুলে দিলো। বাইরে অন্ধকার। দমকা বাতাসের সাথে বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা বিন্দু এসে মুখে ঝাপটা মারলো। বেশ লাগলো বৃষ্টির এমন শীতল স্পর্শ। সানজু ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসের সাথে সাথে বৃষ্টির পানি ঢুকতে লাগলো ঘরে। সানজুও প্রায় ভিজে যেতে লাগলো। চাঁদনী জানালার একটা কপাট আবার বন্ধ করে দিলো। বন্ধ কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে বললো,
"আপু, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ভিজে যাবি তো!"
"ভিজি না একটু, কী আসে যায় তাতে।"
"জ্বর আসতে পারে। গতবার মনে নেই, স্কুল থেকে ফেরার সময় ছাতা না থাকায় ভিজে এসেছিলি। তখন কী হয়েছিল, তীব্র জ্বরে ভুগেছিলি।"
"এই টুকুনি বৃষ্টিতে কিছু হবে না।" কথা বলতে বলতে সানজুর চোখ পড়ল কদম গাছের তলায়। কোনো এক মানুষের অবয়ব চোখে পড়ছে বারান্দার ঝাপসা আলোয়। সানজু চোখ সরু করে দেখতে দেখতে বললো,
"ওইটা কাদা ভূত না রে চাঁদনী?"
চাঁদনী জানালায় উঁকি দিলো।
"সেই তো মনে হচ্ছে!" লোকটাকে ভালো করে দেখে বললো, চাঁদনী।
"লোকটার মাথায় নির্ঘাত কোনো সমস্যা আছে, বুঝলি? সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে জড়িত হওয়ার পাশাপাশি, মাথায় কোনো বড়ো ধরনের সমস্যাও দেখা দিয়েছে হয়তো। জানিস, সে বলেছিল পাখিরা না কি তার সাথে কথা বলে। মনের কথা বলে তার কাছে, বুঝলি মনের কথা?
আচ্ছা, তুই বল পাখি কি কথা বলতে পারে? যদি বলেও সেটা হবে শেখানো কথা। কিছু কিছু পাখি শেখানো কথা বলতে পারে। কোনো পাখি কি আর প্রশ্ন করলেই মানুষের মতো উত্তর দিতে পারে? নিজেদের কষ্টের কথা বলতে পারে? আর আমার পাখি গুলো তো শেখানো কথাও বলতে পারবে না। আমি ছোট থেকে ওদের কোনো কথা শিখাইনি। ওরা যখন বড়ো তখন আমি ওদের এনেছিলাম।"
"কী মনে হয়, লোকটা কি সত্যিই আমাদের মাথায় বারি দিয়ে, আমাদের সব টাকা পয়সা নিয়ে ভাগবে?" কাদা ভূতের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো চাঁদনী। তার গলা কিছুটা চিন্তিত শোনালো।
সানজু ক্ষুদ্রশ্বাস ত্যাগ করে বললো,
"হয়তো, আবার হয়তো না। তবে সেটা করার সম্ভাবনাই বেশি।"
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ০৬ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
শালিক পাখি চারটা কিচির মিচির করছে বারান্দায় বসে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে ঝিরিঝিরি। বাতাস নেই। কাদা জমেছে উঠোনে। সানজু খুদের বাটি আর পানির বাটি নিয়ে বারান্দায় এলো। শৌখিন পাখির খাঁচার সামনে বসে কীসব বকে চলেছিল। সানজু তা দেখেই বাটি দুটো বারান্দার বেঞ্চিতে রেখে, প্রায় ছোঁ মেরে খাঁচাটা তুলে নিলো শৌখিনের সামনে থেকে। খাঁচাটা বেঞ্চির উপর রেখে বললো,
"দয়া করে আমার পাখিদের সাথে কোনো রকম কন্টাক্ট করার চেষ্টা করবেন না। নিজে তো পাগল আছেনই, পাখি গুলোর মাথা অন্তত খারাপ করার চেষ্টা করবেন না। ওরা আপনাকে পছন্দ করে না, তাই ওদের থেকে থেকে দূরে থাকুন।"
শৌখিন হাঁটুর উপর ভর করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
"কে বলেছে পাখিরা আমায় পছন্দ করে না? ওরা তো আমায় ভীষণ পছন্দ করে। বিশ্বাস না হলে নিজেই জিজ্ঞেস করে দেখুন না।"
সানজু একবার পাখির দিকে, আর একবার শৌখিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
"আমি কি আপনার মতো পাগল, যে আমি পাখিদের কাছে জিজ্ঞেস করবো ওরা আপনাকে পছন্দ করে কি না! আমি জিজ্ঞেস করলেই কি ওরা উত্তর দেবে?"
"দেবে।"
"দেবে মানে! কীভাবে দেবে? মানুষের মতো কথা বলবে? ঠিক আছে, দেখছি আমি। দেখি ওরা কী বলে...বলতো পাখি সোনারা, এই লোকটাকে তোরা পছন্দ করিস?"
পাখি গুলো আগের মতোই কিচির মিচির করছে। সানজু ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে তাকালো শৌখিনের দিকে। উল্লসিত কণ্ঠে বললো,
"কী... কী বললো পাখিরা? আমি তো কিছু শুনতে পাইনি। ওরা হ্যাঁ অথবা না কোনটা বললো? না কি আরও অনেক কিছু বলেছে?"
সানজু মুখ টিপে হাসলো। তারপর বেঞ্চির উপর বসে পাখি গুলোকে খাওয়াতে লাগলো। শৌখিন সানজুর গায়ে কালকের মতো একই পোশাক পরা দেখে কিছু একটা চিন্তা করলো। জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললো,
"আপনি কি স্কুলে যাবেন?"
"হ্যাঁ।" শৌখিনের দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিলো সানজু। অতঃপর তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
"আপনি কি কোনোদিন স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করেছেন? কোন স্কুলে লেখা পড়া করেছেন?"
"জানি না।"
সানজু শৌখিনের দিকে কঠিন চোখে তাকায়। গম্ভীর গলায় বলে,
"আমার সাথে মিথ্যা বলবেন না। আপনি জানেন। আপনার সব কিছুই মনে আছে। শুধু ভং ধরছেন যেন কিছুই মনে নেই। আমায় সত্যি কথা বলুন।"
শৌখিন যতটা সম্ভব দৃঢ় ভাবে বলার চেষ্টা করলো,
"সত্যিই জানি না। মনে পড়ে না কিছু। হয়তো স্কুলে পড়েছি, আবার হয়তো না।"
সানজু বুঝতে পারে না শৌখিন মিথ্যা বলছে না কি সত্য। এই লোকটার চেহারা দেখে কিছু বোঝা যায় না। চেহারাটা কত সহজ সরল লাগে, কিন্তু তার ভিতরও মনে হয় আবার হাজারটা প্যাঁচ গোচ। কেমন একটা ধোঁয়াশা ভাব ওই মুখে। কোনো একটা কিছু বুঝে উঠতে গিয়েও আবার সেটা ধোঁয়াশায় হারিয়ে যায়। সানজুর এই প্রথম শৌখিনের চোখ দুটো খেয়াল হলো। চোখ দুটোও অদ্ভুত রকমের শান্ত। ওই চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। মনে হয় ওই শান্ত চোখের গভীরতায় ডুবে অনেক দূর চলে যাচ্ছে। সানজু দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো শৌখিনের চোখ থেকে।
কিছুক্ষণ পর চাঁদনী আসে বারান্দায়। তার গায়েও সানজুর মতো একই পোশাক। সাদা রঙের পায়জামা, স্কার্ফ, ক্রসবেল্ট এবং নীল রঙের জামা। চাঁদনী সানজুকে প্রশ্ন করলো,
"আপু, আমার পানির পট কই?"
"পানির পট? টেবিলে দেখিস না? তাহলে আমার ঘরে আছে হয়তো! গিয়ে খুঁজে দেখ।"
চাঁদনী যেতে নিলে শৌখিন বলে,
"এখন তো বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুলে যাবেন কীভাবে?"
চাঁদনী দাঁড়ালো শৌখিনের কথা শুনে। শৌখিন এমন বেক্কলের মতো কথা বলাতে, চাঁদনী বিরক্তিতে আস্তে করে বললো,
"বলদ।"
এরপর ঘরের ভিতর ঢুকে যায়।
আস্তে করে বললেও শৌখিন ঠিকই শুনেছে চাঁদনীর 'বলদ' বলা। সে সানজুর দিকে তাকিয়ে অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করলো,
"উনি 'বলদ' কাকে বললো? আমাকে?"
"আপনাকে নয়তো কাকে? আপনি ছাড়া আর কেউ আছে এখানে?"
"আপনি আছেন তো।" শৌখিন সহজ কণ্ঠে বললো।
সানজু অপমান বোধ করলো। অপমানের প্রতিবন্ধকতা থেকে কিছুটা রাগি গলায় বললো,
"কী? আমাকে আপনার বলদ মনে হয়? আপনি জানেন আমি কত কঠিন, বড়ো বড়ো অংকের সমাধান মাত্র এক মিনিটে করে ফেলি। অংক স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার সময় সবাই বেতের বারি খায়। শুধু আমি...এই আমি খাই না। যেই অংক আমাকে করতে বলা হয় সব অংক ঘটাঘট করে ফেলি। আমাকে আপনি কোন আক্কেলে বলদ বলেন?"
সানজু রাগে ফুঁসতে থাকে।
শৌখিন বোঝানোর চেষ্টা করে বললো,
"আমি তো আপনাকে বলদ বলিনি। আমি তো এটা বললাম যে, আমার সাথে এখানে আপনিও আছেন। আমি তো আপনাকে মোটেও বলদ বলার চেষ্টা করিনি।"
সানজু এতটাই অপমান বোধ করলো যে, আর এখানে থাকতে পারলো না। পাখির খাঁচা আর বাটি গুলো নিয়ে প্রায় হন হন করে বারান্দা ত্যাগ করলো। যখন শৌখিনের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল তখন অস্পষ্ট গলায় বলে,
"রাম বলদ।"
কথাটা শৌখিনের কান এড়ায়নি। শৌখিন অবাক হয়ে একবার আওড়ালো,
"বলদ! রাম বলদ!"
______________
সানজু, চাঁদনী যখন সব কিছু গোছগাছ করে স্কুলে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়, তখন বারান্দায় এসে দেখে বড়ো ভাই সাব্বির কাঁচি আর কীসব নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তার সামনে একটা চেয়ারে বসে আছে শৌখিন। তার গায়ে একটা সাদা তোয়ালে জড়ানো। সানজু, চাঁদনী বুঝতে পারে কালকে যে বিষয় নিয়ে কথা বলেছে সাব্বির, সেই বিষয় নিয়েই কাজ করছে এখন। চাঁদনীর গা জ্বলে গেল। সে বুঝতে পারছে না তার বাড়ির পুরুষ মানুষ গুলোর কী হলো! সবাই কেন এই শৌখিনকে নিয়ে এমন মাতামাতি করছে।
চাঁদনী ব্যাপারটা ধরতে পেরেও আবার প্রশ্ন করলো,
"ভাইয়া, তুই এখানে কী করিস? কলেজে যাবি নাহ?"
সাব্বির এবার ডিগ্রি ফার্স্ট ইয়ারে। ছাত্র হিসেবে ভালোই। আগে আরও ভালো ছিল। যবে থেকে লেখালেখির ভূত মাথায় চেপেছে, সেই থেকে একটু অবনতি হয়েছে। সাবের সাহেবের ইচ্ছা ছিল সাব্বিরকে ঢাকায় পড়াবেন। কিন্তু সাব্বির দ্বি-মত জানায়। সে অত দূরে গিয়ে একা একা থাকতে পারবে না। সাবের সাহেব কত বুঝিয়েছেন ওখানে গেলে অনেক বন্ধু হবে। প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। সাব্বিরের এক কথা, সে কোথাও যাবে না। সাবের সাহেব আর জোরাজোরি করেননি। তিনি জানেন জোরাজুরির ফল ভালো হয় না। অবশেষে তিনি সাব্বিরকে গ্রামের একটা কলেজে ভর্তি করে দেন। কিন্তু তার ইচ্ছা তিনি সানজু আর চাঁদনীকে ঢাকায় পড়াবেন।
সাব্বির কাঁচি হাতে নিয়ে বললো,
"না। তোরা যা।"
"বাপরে! তোকে তো কলেজ বাদ দিয়ে একদিনও বাড়িতে থাকতে দেখা যায় না ভাইয়া। যেদিন বাজারে বেশি সবজি তোলা হলো, সেদিন মন্টু কাকা, ঝন্টু কাকা কত করে তোকে বললো তাদের সাথে একটু হাত লাগিয়ে সবজি গুলো গাড়িতে তুলে দিতে। একটু সাহায্য করতে বললো শুধু!
অথচ তুই কলেজ যাবার তাড়া দেখিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে চলে গেলি। আর আজ বাড়িতে কোনো কাজ কাম নেই, অথচ তুই বাড়িতে বসে..."
সাব্বির চাঁদনীর কথা শেষ করতে দিলো না। মেজাজ দেখিয়ে বললো,
"যা তো এখান থেকে। সকাল সকাল মেজাজ খারাপ করে দিস না।"
চাঁদনী কিছু বলতে যাচ্ছিল, সানজু হাত ধরে থামালো। সানজুর দৃষ্টি ছিল শৌখিনের উপর। সে তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হাতে থাকা ছাতা মেলে নেমে পড়ে বৃষ্টির মাঝে। চাঁদনীও যাচ্ছে সানজুর পিছন পিছন। ওরা বাড়ির বাইরে চলে গেলে সাব্বির বললো,
"বুঝলেন শৌখিন ভাই, আপনি হলেন আমার প্রথম কাস্টমার। এর আগে জীবনে কখনো কারো চুল কাটিনি। আপনিই প্রথম।"
শৌখিন হাসলো। তারপর হঠাৎ করে প্রশ্ন করলো,
"আচ্ছা ভাই, বলদ আর রাম বলদের মাঝে পার্থক্য কী?"
সাব্বির একটু হকচকিয়ে গেল। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললো,
"ঠিক জানি না ভাই। তবে মনে হয়, বলদের থেকে রাম বলদ শব্দটা একটু বেশি অপমান জনক।"
শৌখিন বুঝদারের মতো বললো,
"ও..."
______________
মন্টু ঘুম থেকে উঠে এমন একটা সারে সর্বনাশ অবস্থা দেখবে কল্পনা করেনি। সে দৌঁড়ে গেল শৌখিনের কাছে। শৌখিন চেয়ারে বসে ছিল। মন্টু দু হাত দিয়ে শৌখিনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আতংকিত গলায় বললো,
"আয় হায়! কই গেল সব? আয় হায়, কে করলো এমন সর্বনাশ?"
শৌখিন মাথা তুলে তাকিয়ে বললো,
"আপনি এমন করছেন কেন, ভাই?"
পাশ থেকে সাব্বির বললো,
"মন্টু কাকা বোধহয় পাগল হয়ে গেছে!"
মন্টু হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
"চোপ!"
"...'চোপ' কী, মন্টু কাকা? বাংলা অভিধানে 'চোপ' বলতে কোনো শব্দ আছে?"
"তোর ফ্যাচফ্যাচানি থামা। আমাকে বাংলা অভিধান শেখাতে আসিস না, আমি অভিধান সম্পর্কে যথেষ্ঠ জানি। এই মুহূর্তে এইসব নিয়ে তোর সাথে কথা বাড়াতে চাই না। এখন কথা হবে অন্য বিষয় নিয়ে।
তোরা কি দেখছিস না ভূত ভায়ার মাথা থেকে সুন্দর চুল গুলো উধাও?"
"তুমি তো এমন করে কথা বলছো যেন তার মাথা ন্যাড়া হয়ে গেছে, একটা চুলও অবশিষ্ট নেই।"
"তা ন্যাড়া হওয়ার আর বাকিটা রইল কী? যে চুল ছিল বারো ইঞ্চি, সেটা এখন দেখায় দুই ইঞ্চির মতো! ভূত ভাই, বলেন তো কে আপনার মাথায় এমন সর্বনাশ ঘটালো? গরুর পশমের মতো চুলের অবস্থা করলো কে? কে সেই কুখ্যাত অপরাধী?"
সাব্বির বিরক্ত হলো। বিরক্তি ধরা কণ্ঠে বললো,
"তোমার সব কিছুতে বাড়াবাড়ি, মন্টু কাকা। তার চুল তো ঠিকই আছে। বরং আগে ঠিক ছিল না।"
"ও বুঝতে পারছি। তুই তাইলে এই সর্বনাশকারী!"
মন্টু এগিয়ে গেল সাব্বিরের দিকে। সাব্বিরের চুল দু হাতের মুঠোয় নিয়ে আলতো করে টানতে টানতে বললো,
"কোন সাহসে...কোন সাহসে ভূত ভায়ার অমন সুন্দর চুল গুলো গরুর পশমের মতো বানালি? হা ? জবাব দে।"
"ছাড়ো, ব্যথা পাচ্ছি তো।" সাব্বির মন্টুর হাত ছাড়িয়ে নিলো।
মন্টু শৌখিনের দিকে তাকালো। অসন্তুষ্ট গলায় বললো,
"আর আপনি ভূত ভাই! আপনি কীভাবে নিজের চুল গুলো এমন গরুর পশমের মতো বানাতে দিলেন? লম্বা চুলে আপনাকে কত সুন্দরই না লাগছিল!"
"মন্টু কাকা, থামো তুমি। তোমার চোখ খারাপ হয়ে গেছে। ভালো জিনিস চোখে দেখো না তুমি।"
কথা গুলো বলে সাব্বির চলে গেল।
শৌখিন মৃদু হেসে উঠে এলো মন্টুর কাছে। মন্টুর কাঁধে এক হাত রেখে বললো,
"আপনার যদি আমায় লম্বা চুলে দেখতে ভালো লাগে, তবে আমি একটা কাজ করি..."
"কী কাজ করবেন, ভূত ভাই?"
"আমি একটা আলগা চুল কিনবো।"
"আলগা চুল কি, ভূত ভাই?"
"ওই যে যাদের মাথা ন্যাড়া অথবা টাক থাকে..."
শৌখিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই, মন্টু বলে উঠলো,
"ও বুঝছি, বুঝছি...কিন্তু ভূত ভায়া অমনটা করতে গেলে কষ্ট হবে আপনার। থাক দরকার নেই। ছোট চুলে দেখতে দেখতে এক সময় মানিয়ে নেবো।"
মন্টু হাসলো একটু। শৌখিনও প্রতিউত্তরে হাসলো।
_____________
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। প্রকৃতি তলিয়ে যায় আঁধারে। নিকষ কালো আঁধার। দূরে কোথাও পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। এক সাথে অনেক পাখির ডাকের সংমিশ্রণ। ঘরের শালিক গুলো নিশ্চুপ। সাবের সাহেব নামাজ পড়ে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। তারপর তাঁর শখের দাবা নিয়ে বসে মেঝেতে। দাবার কোডটা মেলতেই উপস্থিত হয় শৌখিন। সাবের সাহেব রুমে একা ছিল। হেলেনা ঘরের পিছনের রান্না ঘরে আছে। পিঠা বানাচ্ছেন তিনি। শৌখিনের জন্য বানাচ্ছেন। পারভেনু বিবিও হেলেনার সাথে। বাড়িতে কোনো অতিথি থাকলে, তাকে পিঠা না খাওয়ালে বেমানান লাগে হেলেনার কাছে। তাই তো বিকালে রতনকে দিয়ে গাছ থেকে দুটো নারিকেল পারিয়েছে। রতন এ বাড়ির কৃষি ক্ষেতের দায়িত্বে আছে, সাথে অন্যান্য টুকটাক কাজও করে দেয়।
সানজু, চাঁদনী যে যার ঘরে পড়ছে। মন্টু আর ঝন্টু আযান দেওয়ার সাথে সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। মসজিদে নামাজ পড়ে, বাজারে বসে খানিক আড্ডা মেরে তারপরই ঘরে ফিরবে। এটা তাদের রোজকার নিয়ম। বৃষ্টির দিনেও তাদের রুটিন চেঞ্জ হয় না।
সাব্বির আছে নিজের ঘরে। বই পড়ছে। পড়ার মাঝে মাঝে মাথায় কিছু আসলেই সেটা টুপ করে নোটবুকে লিখে নিচ্ছে।
সাবের সাহেব শৌখিনকে দেখে, হেসে ভিতরে ঢুকতে বললেন। শৌখিন ঢোকে। সাবের সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
"কেমন আছো?"
"জি ভালো। আপনি?"
"ভালো।"
সাবের সাহেব লক্ষ্য করলেন শৌখিন দাবার কোডের দিকে তাকিয়ে আছে। সাবের সাহেব উৎসাহ নিয়ে বললেন,
"কী, খেলতে পারো দাবা?"
শৌখিন দুই পাশে মাথা নেড়ে বললো,
"আজ্ঞে না। তবে শিখিয়ে দিলে নিশ্চয়ই পারব।"
সাবের সাহেব আনন্দিত কণ্ঠে বললো,
"ঠিক আছে বসো তবে। শিখিয়ে দিই নিয়ম কানুন।"
শৌখিন বসে। সাবের সাহেব সকল কায়দা কানুন শেখাতে শুরু করলো। শৌখিনের এসব শিখতে খুব একটা সময় লাগলো না।
তারপর এক সাথে দাবা খেললো। শৌখিনের কাছে বেশ লাগলো খেলাটা। অনেকক্ষণ ধরে দাবা খেলার পর, হেলেনার ডাক পড়ে। শৌখিন চলে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায়,
"আপনি আমার দেখা আরেক জন ভালো মানুষ।"
সাবের সাহেবের হৃদয়টা ভিজে যায়। কে জানে কী ছিল ওই কথায়! কোন অদৃশ্য শক্তি লুকিয়ে ছিল। তবে আবার প্রশ্নও জাগে মনে। যদি ছেলেটার কিছু মনেই না থাকে, তাহলে 'আরেক জন' শব্দটা কেন ব্যবহার করলো? এর আগেও নিশ্চয়ই সে অনেক ভালো মানুষ দেখেছে, আর সেটা মনেও আছে। যদি এটা মনে থাকে তাহলে তো সব কথাই মনে আছে নিশ্চয়ই। মনে থাকা সত্ত্বেও কি তবে সব কিছু মনে না পড়ার ভাণ করছে? কেন?
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ০৭ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
সাবের সাহেব সকাল সকাল তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হলেন থানায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রাতে পুলিশ অফিসার হানিফ ফোন করেছিল। সাবের সাহেবকে যেতে বলেছেন। সাবের সাহেব বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় চাঁদনী জিজ্ঞেস করে,
"কোথাও যাও, আব্বা?"
সাবের সাহেব উত্তর দেন,
"থানায়।"
চাঁদনী কথাটা শুনে খুশি হয়। দৌঁড়ে আসে সানজুর কাছে। সানজু বসে ছিল টেবিলের সামনে। স্কুলের ব্যাগ গুছাচ্ছিল। চাঁদনীকে দৌঁড়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে গেল।
"আপু, আব্বা থানায় গেছে।" হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে বললো চাঁদনী।
সানজুর মুখেও হাসি ফোঁটে। আনন্দঘন কণ্ঠে বললো,
"দেখিস চাঁদনী, এবার ওই লোকটার আসল চেহারা প্রকাশ পাবে।"
চাঁদনী মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হুম।"
শৌখিন সানজুর ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। সানজুর আনন্দঘন কণ্ঠ শুনতে পেলো সে। শৌখিন হাসলো। সে বুঝতে পারছে না, এই দুই বোন কেন তাকে দেখতে পারে না! শৌখিন নিঃশব্দে হাসতে হাসতে চলে গেল।
চাঁদনী বললো,
"আমি রেডি হই গিয়ে। প্রায় নয়টা বেজে আসছে।"
"যা।"
চাঁদনী বেরিয়ে গেল সানজুর ঘর থেকে। সানজু আবার বসলো চেয়ারে।
____________
সাবের সাহেব হানিফের সামনে বসা। হানিফ ইতস্তত করে বললো,
"ছেলেটার কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। কী নাম, কোথায় বাড়ি, মায়ের নাম, বাবার নাম, কিছুই না। কেউ চেনেও না। আশেপাশে আরও কয়েকটা থানায় যোগাযোগ করেছি, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ওই ছেলের ব্যাপারে কেউ কোনো তথ্য খুঁজে পায়নি। এই এরিয়ার সাথে সাথে আশপাশের এরিয়ার মধ্যেও ওই রকম মুখ আগে কখনো কেউ দেখেনি।"
সাবের সাহেবের মুখ চিন্তিত দেখালো। তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছেন।
হানিফ চিন্তিত গলায় বললো,
"এখন কী করবেন, সাবের সাহেব? ছেলেটা ছোটও নয় যে কোনো এতিমখানায় পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। বিশ-একুশ বছরের ছেলে। কী করবেন?"
সাবের সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
"দেখি কী করা যায়। সব কিছুর জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।"
হানিফের মনে হয় সাবের সাহেব খুশি হননি। হানিফ বিনীত গলায় বললো,
"আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত..." হানিফ থামলো। তারপর আবার বললো,
"আমি এখনও চেষ্টা করবো খুঁজে বের করতে। কিন্তু মনে হয় না কোনো কাজ হবে। তবুও আমি চেষ্টা করবো।"
"চাপ নেবেন না। ধীরে সুস্থে কাজ করুন।"
সাবের সাহেব করমর্দন করে হানিফের সাথে। বের হন থানা থেকে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। সাবের সাহেব গায় লাগালেন না। ছাতা না মেলেই হাঁটতে শুরু করলেন সে। সাবের সাহেব বুঝতে পারছেন না পরিচয় খুঁজে না পাওয়াতে তিনি খুশি না অখুশি! কিন্তু তাঁর মনে হচ্ছে ছেলেটা চলে গেলে তার খারাপ লাগবে।
সাবের সাহেব বাজারের পথ ধরলেন। বাজার করে বাড়ি ফিরবেন।
_____________
দুপুর গড়িয়ে বিকেলে পড়েছে। বৃষ্টি হয়েছিল সকালের দিকে। প্রায় দুপুর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।পানি এখনও শুকায়নি। মাটি কর্দমাক্ত। গাছে গাছে পানি। ফুল গাছ গুলো কী সতেজ! দেখলে চোখ জুড়ায়।
চাঁদনী ছাদে বসে আছে পা ঝুলিয়ে। আমের আচার খাচ্ছে। মনটা ভালো না। সকালে আব্বাকে থানায় যেতে দেখে ভেবেছিল ভালো কোনো খবর আসতে চলেছে। ভেবেছিল আপুর কথাই সত্যি হবে। পুলিশের তদন্তে লোকটার আসল রূপ প্রকাশ পাবে। তারপর বাড়ির লোকজন তাকে বের করে দেবে, আর পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ঢুকাবে। কিন্তু স্কুল থেকে ফিরে যখন শুনলো লোকটার কোনো পরিচয়ই পাওয়া যায়নি, তখন মনের সকল আনন্দ মিলিয়ে যায়। চাঁদনী হতাশ ভাবে আমের আচার মুখে দিলো। ছাদে কারো উপস্থিতি টের পাওয়া গেল। চাঁদনী ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরলো। শৌখিন!
চাঁদনী চোখ সরিয়ে নিলো। কিছুই ভালো লাগছে না। ক্লান্ত লাগছে। শৌখিন চাঁদনীর কাছে এসে দাঁড়ালো। প্রশ্ন করলো,
"কী করছেন?"
চাঁদনী বিরক্ত হয়। তবুও ভালো ভাবে উত্তর দিলো,
"আচার খাচ্ছি, দেখেন না?"
"আ-চা-র? আচার কী জিনিস?"
চাঁদনী চমকে উঠে।
"ওমা! এসব কী শুনি! আচার কি তা জানেন না? কোন জগতে থাকেন আপনি?"
"এই জগতেই তো আছি।" বলতে বলতে শৌখিন চাঁদনীর পাশে বসলো। একেবারে পাশাপাশি বসাতে চাঁদনী বিব্রত বোধ করে। একটু দূরে সরে বসলো চাঁদনী।
শৌখিন বললো,
"...'আচার' কী তা তো বললেন না!"
চাঁদনীর ইচ্ছা হলো, কয়েকটা গালি শোনায় শৌখিনকে। কিন্তু গালি দেওয়ার তেজ খুঁজে পেল না। কিন্তু আচার কী তা ব্যাখ্যা করবে কী করে? চাঁদনী একটু ভাবলো। তারপর বললো,
"আচার হলো টক, ঝাল, মিষ্টি, তেল ইত্যাদি সহযোগে তৈরি মুখরোচক চাটনি জাতীয় খাবার। যা মূলত ফল দিয়ে বেশি বানানো হয়। টক, ঝাল, মিষ্টি সংমিশ্রণেও আচার বানানো যায়, আবার মিষ্টি ছাড়া শুধু টক ঝাল আচারও বানানো যায়। আর আচার দীর্ঘদিন সংরক্ষণও করা যায়, তেল-লবণ অথবা ভিনেগারের সাহায্যে। আর এর স্বাদও অতুলনীয়। খেয়ে দেখেন।"
চাঁদনী একটু আচার এগিয়ে দিলো শৌখিনের দিকে। শৌখিন খেয়ে বললো,
"হুম, ভালো খেতে।"
চাঁদনী একটু হাসলো।
শৌখিন বললো,
"ধন্যবাদ, আচার সম্পর্কে আমায় অবগত করার জন্য। ধন্যবাদ আপনাকে।"
চাঁদনীর মুখ গোমড়া হলো। শৌখিনের দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
"আপনি আমাকে আপনি, আপনি করে বলেন কেন? আমি আপনার থেকে কত বছরের বড়ো?"
শৌখিন ঠোঁট উল্টে বললো,
"উম...আপনার বাবা বলেছেন একুশ কী বাইশ হবে আমার বয়স।"
"তাহলে? আমার বয়স কত জানেন? চৌদ্দ। এখন গুনে দেখেন আমি আপনার থেকে কত বছরের বুড়া।"
শৌখিন গুনে বললো,
"আমার মনে হয়, আমি আপনার থেকে আট-নয় বছরের বুড়া।"
চাঁদনী ফিক করে হেসে দিলো। একটা মানুষ এমনও হয়। সত্যিই পাগল! চাঁদনী হাসি থামিয়ে বললো,
"শোনেন, এরপর থেকে আমাকে আর আপনি করে বলবেন না। নিজেকে বুড়া, বুড়া লাগে।"
"তাহলে কী বলবো?"
"তুমি করে বলবেন।"
শৌখিন চিন্তায় পড়লো। মাথা চুলকে বললো,
"আপনার বড়ো বোনকেও কি তুমি করে বলা উচিত?"
"অবশ্যই। আপুও তো আপনার থেকে অনেক ছোট। আমার থেকে মাত্র দুই বছরের বড়ো। ও কেও তুমি করে বলবেন।"
"ঠিক আছে।"
শৌখিন আর কোনো কথা বললো না। চুপচাপ সবুজ ঘন প্রকৃতি দেখতে লাগলো।
_____________
বাইরে সুনশান নীরবতা। আকাশে কালো মেঘ। হালকা অন্ধকার ছেয়ে ফেলেছে পরিবেশ। যদিও সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসেনি। সানজু এসে সদর দরজায় দাঁড়ালো। মনে মনে অসন্তুষ্ট সে। ভেবেছিল কী, আর হলো কী! ধ্যাৎ! পুলিশ কী করে লোকটার কোনো পরিচয় খুঁজে পেলো না? হোক লোকটা সন্ত্রাসী দলের না, মেনেই নিলাম। তাই বলে কোনো পরিচয়...
সানজু আর ভাবতে পারে না। দাঁড়িয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে। হঠাৎ প্রবেশদ্বারে শব্দ হওয়ায় সানজু একটু কেঁপে উঠে বেখেয়ালে। তাকায় সেদিকে। আব্বাস প্রবেশ করছে বাড়িতে। হাতে তার মস্ত বড়ো কালো দুটো ব্যাগ। মূলত বাড়ির প্রবেশদ্বারের কাছে এসে পায়ে কাদা লেগে যায় কোনো ভাবে, আব্বাস বিরক্ত হয়। আর রাগে পাশে থাকা একটা কাটা সুপারি গাছে আঘাত করে পা দিয়ে। সেখান থেকেই শব্দের উৎপত্তি। আব্বাসকে দেখে সানজু ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল দ্রুত। সে আব্বাসের মুখোমুখি হতে চায় না। সানজু নিজের রুমে চলে আসে। এই একটা লোক, যার কাছ থেকে সব সময় দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করে সানজু। কিন্তু এই অসময় আব্বাস ভাই এখানে এসেছে কেন?
_____________
অন্ধকার ইতোমধ্যে ছেয়ে ফেলেছে পরিবেশ। বাইরে কোথায় যেন একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চলেছে। উঠোনে চলছে তর্কাতর্কি। মন্টু আর ঝন্টুর মধ্যে। শৌখিন আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তা।
সাবের সাহেব রয়েছেন নিজের ঘরে। সাথে আব্বাস।
আব্বাস কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সাবের সাহেবের দিকে অসন্তোষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
"বাড়িতে দুইডা যুবতী মাইয়া থাকতে আপনে কেমনে ওই পোলারে ঘরে স্থান দিলেন, মামা?"
সাবের সাহেবের দূর সম্পর্কের এক বোনের ছেলে আব্বাস। আব্বাসের স্বভাব তেমন ভালো না। আব্বাসকে দেখতে পারেন না সাবের সাহেব। তবুও আব্বাস হুটহাট করে এসে উপস্থিত হয় বাড়ির উপর। আগে এমন করতো না। আগে দেখা সাক্ষাৎই হতো না খুব একটা। কয়েক বছর আগে সাবের সাহেব ঠ্যাকায় পড়ে খুব জরুরি কাজের জন্য, কিছু জমি বন্ধক রেখে টাকা এনেছিলেন আব্বাসের বাবা আলমের কাছ থেকে। সে সময় আলম একদিন কথায় কথায় বলে,
"সানজু মা'রে আমি আমার আব্বাসের বউ কইরা ঘরে আনবার চাই। তুমি কী কও, সাবের?"
সাবের সাহেব অত্সব পাত্তা দেননি। উনি নির্বিকার ভাবে বলেন,
"সেসব দেখা যাবে পরে একক্ষণে। মেয়েদের বিয়ে নিয়ে আমি এখন কিছু ভাবি না।"
ব্যস, সেই কথা ধরেই বসে আছে তারা। সেই থেকে আসা যাওয়া করছে। সাবের সাহেব পরে অবশ্য ব্যাপারটা খোলাসা করেন। কিন্তু তার কথা গায় লাগায়নি কেউ। তারা অযথাই ধরে বসে আছে, সানজু এক সময় আব্বাসের বউ হয়ে ঘরে যাবে।
আব্বাসের কথা শুনে সাবের সাহেবের রাগ হলো। কিন্তু বাইরে প্রকাশ করলো না। শান্ত শীতল কণ্ঠে বললেন,
"আমার মেয়েদের চিন্তা আমি ভালো করতে জানি। তোমাকে এই নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আমার মেয়েদের কীসে ভালো সেটা আমি ভালো করেই জানি।"
"আপনে জানলে তো..." আব্বাস থেমে যায়। দম নিয়ে আবার বলে,
"ওই পোলার মতিগতি ভালো না। ধান্দা কইরা এই বাড়িতে পইড়া রইছে। দুইটা সুন্দর মাইয়া দেখছে তো, তাই ভং ধরছে। ওই পোলারে এইহানে রাখলে কোনহান থেইকা কী হইয়া যায় কে জানে! কিছু ঘটনের আগে ঘাড় ধাক্কা দিয়া বাইর কইরা দেন। সময় আছে অহনো।"
সাবের সাহেবের রাগ আগের থেকে চড়াও হয়। কিন্তু এবারও সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখেন। তার এ বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললেন,
"হঠাৎ করে আমার বাড়িতে উদয় হলে কেন?"
আব্বাসের অসন্তোষ চেহারায় হাসি ফোটে।
"ও আপনেরে কওয়া হয় নাই! আমি তো ঢাকা যাইতেছি। দোকানে নতুন কাপড় উঠাইতে হইবো। ভাবলাম ঢাকা যাওনের আগে আপনে গো বাড়ি বেড়াই যাই দুইদিন। আপনে গো কার কী লাগবো হেইডা জাইনা যাই... আপনের কী লাগবো, মামা? আমারে কন। আমি শহর থেইকা সব কিছু নিয়া আসমু।"
সাবের সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন,
"আমার কিছু লাগবে না।"
"আরে লাগবো না কইলেই হইলো। আপনে কন আমারে, কী লাগবো। আচ্ছা অহন কওয়ন লাগবো না। ভাইবা টাইবা হেইর পর কইয়েন।"
আব্বাস আর কথা বললো না সাবের সাহেবের সাথে। বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
আব্বাস বেরিয়ে গেলে, সাবের সাহেবের মনে প্রশ্ন জাগে,
'আচ্ছা! সত্যিই কি ছেলেটা ধান্দা করে বাড়িতে আছে? না। চেহারা, আচার-ব্যবহার দেখেতো মোটেই তেমন মনে হয় না। কিন্তু...ছেলেটার কোনো পরিচয় পাওয়া গেল না কেন? নিজেদের থানা ছাড়াও আশেপাশের প্রায় কয়েকটা থানাতেই খোঁজ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। একটা মানুষ এমন ভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে কী করে?'
সাবের সাহেবের মাথায় চিন্তারা ঝেঁকে বসে। তিনি ঠিক ভেবে উঠতে পারেন না কিছু। ছেলেটা হুট করেই এলো বৃষ্টির মাঝে, কাদা মেখে। তাও আবার যেই সেই কাদা না! প্রথমে কোনো কথা বলেনি, চুপচাপ থেকেছে। পরে অবাক করে দিয়ে বললো, সে তৃতীয়বার কথা বলার পর, ছেলেটা তার কথা বুঝতে পেরেছে। এবং সে নিজেও এখন বাংলা বলতে পারে, ভাষাটা আয়ত্ত হয়ে গেছে তার। মানে কী ছিল এসবের?
সাবের সাহেব যতই ভাবছে এসব নিয়ে, ততই এলোমেলো লাগছে। কোনো কিছুর উত্তরই ঠিক ভাবে মেলাতে পারছেন না।
সাবের সাহেব ঘর থেকে বের হলেন। হেলেনার কাছে গিয়ে বললেন,
"শৌখিনকে ছাদে পাঠিয়ে দিয়ো। আর দুই কাপ চা'ও দিয়ো।"
হেলেনা কোনো প্রশ্ন করলেন না।
সাবের সাহেবের কথা মতো শৌখিনকে পাঠিয়ে দিলো ছাদে।
শৌখিন ছাদে এসে দেখলো সাবের সাহেব পুরোনো দিনের সুন্দর কারুকাজ করা বড়ো একটা চেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে আরও একটা চেয়ার পাতা। শৌখিন এগিয়ে গেল। সাবের সাহেব চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। শৌখিনের পায়ের শব্দে সম্বিৎ ফিরে পায়। সাবের সাহেব সামনে চেয়ারটা দেখিয়ে বললেন,
"বসো।"
শৌখিন বসলো। মৃসু হেসে বললো,
"আমাকে কেন ডেকেছেন? আমায় নিয়ে চিন্তিত আপনি? ভাবছেন কেন আমার কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি? ঠিক কে আমি?"
সাবের সাহেবের চোখ দুটো আপনা থেকেই বড়ো হয়ে গেল। শৌখিনকে ভালো করে পরখ করে নিয়ে বললো,
"তুমি কীভাবে জানলে যে আমি ঠিক এসব নিয়েই ভাবছি?"
শৌখিন আবার হাসলো। তবে হাসিটা আগের মতো না। সাবের সাহেবের কাছে অদ্ভুত মনে হলো সেই হাসি! শৌখিন খুব শান্ত শীতল কণ্ঠে বললো,
"কী মনে হয়? কীভাবে জানলাম আমি?"
সাবের সাহেব অবাক দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলো শৌখিনকে। ছেলেটা যেন এই মুহূর্তে আগের মতো নেই। পাল্টে গেছে। ভীষণ ভাবে পাল্টে গেছে! হাজারটা রহস্যের জাল গায়ে জড়িয়ে যেন বসে আছে!
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ০৮ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
আকাশে ঘন কালো মেঘের আনাগোনা। শীতল হাওয়া বইছে থেমে থেমে। সাবের সাহেব শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শৌখিনের দিকে। কিছু বলছে না। শৌখিনও তাকিয়ে আছে। ভালো করে সাবের সাহেবকে কিছুক্ষণ দেখে হঠাৎ হেসে উঠলো সে। সাবের সাহেবের ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠলো। শৌখিন নিজের হাসি থামিয়ে বললো,
"আঙ্কেল, আমি তো শুধু ধারণা করেছিলাম যে আপনি এসব নিয়ে ভাবছেন। কিন্তু আমি জানতাম না যে আপনি সত্যিই এসব নিয়েই ভাবছিলেন। আপনি থানা থেকে ওসব শুনে এসেছেন বলে, আমি ধারণা করেছিলাম যে আপনি আমার ব্যাপারে ভাবছেন। এটা শুধুই আমার ধারণা ছিল। আপনি এত ভীত হয়ে পড়েছেন কেন?"
কথা গুলো শৌখিন হেসে উড়িয়ে দিলেও, সাবের সাহেবের মনের ভাবনা কমাতে পারলো না। তার মনে ভাবনা রয়েই গেল। সাবের সাহেবের মনে দুশ্চিন্তা থাকলেও একটু হাসলো। বোঝাতে চাইলেন উনি শৌখিনের কথা মেনে নিয়েছে।
শৌখিন ঠোঁট থেকে হাসির রেশ টুকু মুছে, সিরিয়াস হয়ে সাবের সাহেবকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
"আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার দ্বারা কোনো ক্ষতি হবে না আপনাদের। আমি কোনো ক্ষতি করবো না আপনাদের। আস্থা রাখুন, বিশ্বাস করুন আমায়!"
"যদি না করি?" আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন সাবের সাহেব। উনি দেখতে চান শৌখিন কী উত্তর দেয়।
"বিশ্বাসের উপরই মানুষ টিকে থাকে। বিশ্বাস করুন আমায়। যদি বিশ্বাস করেন, তবে দেখতে পাবেন আমি সত্যিই একজন ভালো মানুষ।"
সাবের সাহেব চোখ সরিয়ে নিলেন শৌখিনের থেকে। অন্ধকারে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু একটা ভাবতে লাগলেন।
এর মাঝে হেলেনা এলেন দুই কাপ চা নিয়ে। টেবিলের উপর ট্রে রেখে উনি আবার চলে গেলেন। হেলেনা বরাবরই শান্তি প্রিয় মানুষ। কোনো কিছু নিয়ে খুব বেশি একটা আগ্রহ দেখান না।
শৌখিন নিজে একটা কাপ হাতে নিয়ে, অপর কাপটা এগিয়ে দিলো সাবের সাহেবের দিকে। সাবের সাহেব কাপ হাতে নিয়ে, চায়ে ফুঁ দিয়ে এক চুমুক পান করলেন।
শৌখিনও চুমুক দিলো চায়ের কাপে।
সাবের সাহেব মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তারপর খোলাসা ভাবে বললেন,
"তোমার কথাবার্তা শুনে তো মনে হয় না যে, তোমার আগের কিছু মনে নেই। তোমার সত্যিই কি কিছু মনে পড়ে না? কোথায় বাড়ি, কী নাম, মায়ের নাম, বাবার নাম, কিছু না?"
শৌখিন চায়ের কাপে আরেকবার চুমুক দিয়ে বললো,
"আপনার কী ধারণা?"
"আমি সঠিক ভাবে কিছু ধারণা করতে পারছি না বলেই তো তোমার কাছে জানতে চাইছি।"
শৌখিন সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললো না। নিচের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলো! তারপর আবার সাবের সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
"আসলেই আমার মনে নেই। এবং আমি চেষ্টা করেও কিছু মনে করতে পারছি না!"
শৌখিন কথাটা বলার সময় সাবের সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। একটা মানুষ সত্যি বলছে, না কি মিথ্যা বলছে সেটা তার চেহারায় ফুঁটে ওঠে। কিন্তু সাবের সাহেব শৌখিনের দিকে তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে থেকেও কিছু ঠাহর করতে পারলেন না। সত্যি বললো ছেলেটা? না কি মিথ্যা?
সাবের সাহেব আর কিছু বললেন না শৌখিনের সাথে।
শৌখিন খালি চায়ের কাপ দু টো নিয়ে চলে যাচ্ছিল। সাবের সাহেব হঠাৎ পিছন থেকে বললো,
"তোমাকে যদি আমি বাড়ি থেকে বের করে দিই, তাহলে কী করবে?"
শৌখিন দাঁড়ালো। পিছন ফিরলো। মৃদু হেসে বললো,
"কিছুই করবো না। কারণ আপনি তো আমায় বাড়ি থেকে বেরই করে দেবেন না।"
শৌখিন মুখে মৃদু হাসি ধরে রেখেই চলে গেল।
শৌখিন চলে যেতেই সাবের সাহেব অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে উঠলেন,
"ছেলেটা বলে কী?"
______________
চাঁদনী আবার জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাস পরিপূর্ণ করলো। তারপর পুরো পানি ঢকঢক করে পান করলো। এই দুই গ্লাস পানি পান করলো। বেশি পানি পান করা ভালো, সেটা জানে চাঁদনী।
চাঁদনী যখন খাবার রুম থেকে বের হবে, তখন আব্বাস প্রবেশ করলো সেখানে। চাঁদনীকে দেখে আব্বাস বললো,
"ভালো আছো চাঁদনী?"
চাঁদনী একটু বিরক্ত হয়। চাঁদনী ভালো করেই জানে আব্বাসের ত্যাড়া বাঁকা কথা বলার স্বভাব আছে। আর চাঁদনীর মোটেই ত্যাড়া কথা ভালো লাগে না। মুখে জোরপূর্বক হাসি ঝুলিয়ে বললো,
"জি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন, আব্বাস ভাই?"
"আমি তো ভালাই আছি। তা, তোমার বইনে কই? হেরে যে দেহনই যায় না! একটা মানুষ বাড়ির উপর আসলে একটু দেখা সাক্ষাৎও তো দেয় মাইনষে, না কি?"
"আপু তো নিজের রুমে। মাথা ব্যথা করে তাই শুয়ে আছে। বের হবে না রুম থেকে। কাউকে ডিস্টার্ব করতেও নিষেধ করছে।" শেষের কথাটা চাঁদনী আব্বাসের উদ্দেশ্যে বললো। আর মাথা ব্যথার কথাটাও মিথ্যা।
"হায়, হায়! মাথা ব্যথা করে? কহন থেইকা?" আব্বাসের গলায় উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেল।
"দুপুর থেকে। কাউকে ডাকাডাকি করতে নিষেধ করে দিয়েছে।"
আব্বাস টেনে বললো,
"ও...তাইলে আর ডাকাডাকি কইরো না তোমরা।"
আব্বাস আবার বললো,
"আচ্ছা, কও তো তোমগো বাপে মানুষ না অন্য কিছু? ওইরকম একটা পোলারে কেমনে ঘরে জায়গা দিলো?"
"কার কথা বলছেন, আব্বাস ভাই? শৌখিন?"
"হ, তার কথাই কই। পোলাডা বেশি সুবিধার না।"
চাঁদনী মনে মনে ভেংচি কাটলো আব্বাসের কথা শুনে। বললো,
"আপনি কীভাবে বুঝলেন সে সুবিধার না? চিনেন না কি তাকে?"
"না, চিনি না। তয় তার মুখ দেখলেই বোঝন যায়, সে সুবিধার না। কহন কোথা থেইকা কী কইরা ফালায় তার তো কোনো গ্যারান্টি নাই। তোমরা বড়ো, বড়ো দুইটা বইন ঘরে।"
নিজেরা শৌখিনকে নিয়ে এটা ওটা বললেও, আব্বাসের মুখে শৌখিনকে নিয়ে এমন কথা শুনতে ভালো লাগলো না চাঁদনীর।
বললো,
"তাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না আপনার। সে অবশ্যই ভালো লোক।"
কথা গুলো বলে চাঁদনী আর দাঁড়ালো না, চলে গেল ওখান থেকে।
_____________
কদম তলায় বেঞ্চির উপর বসে আছে শৌখিন। একটা কদম পড়ে আছে সামনে। পায়ের কাছ থেকে একটু দূরে। শৌখিনের ইচ্ছে হয় কদমটা হাতে তুলে নিতে। আবার সেদিনের সানজুর হুমকির কথা মনে হতেই ইচ্ছেটা দমে যায়। শৌখিন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কদমটার দিকে। কাছে কারো কাশির শব্দ পাওয়া গেল। শৌখিন চোখ তুলে তাকালো। সামনে আব্বাস দাঁড়ানো। আব্বাসের সাথে এর আগে একবার কথা হয়েছে শৌখিনের। শৌখিন সৌজন্য স্বরূপ বেঞ্চির এক পাশে গিয়ে অর্ধেক জায়গা ছেড়ে দিলো আব্বাসের জন্য। আব্বাস শৌখিনের দিকে তাকিয়ে হেসে কদমটা তুলে নিয়ে, বসলো শৌখিনের পাশে। বললো,
"ফুলের দিকে তাকাই আছিলেন ক্যান?"
"এমনি।"
আব্বাস একবার আওড়ালো,
"এমনি!" তারপর আবার বললো,
"তা, ভাইজানের বাড়ি কই? অনেক দূরে না কি? এই গ্রামে তো না। আশে পাশের কোনো গ্রামের হলেও চিনতাম আমি। গ্রামের নাম কি আপনের?"
"জানি না। মনে করতে পারছি না।"
"মনে করতে পারতেছেন না, তার মানে মাথায় সমস্যা? মাথায় সমস্যা হইলে এইহানে আছেন ক্যান? এইডা তো কোনো হাসপাতাল না, আর কোনো ডাক্তারও নাই এই বাড়িতে। মাথায় সমস্যা হইলে তো ডাক্তারের কাছে যাইতে হয়। এই বাড়িতে পইড়া আছেন ক্যান?"
শৌখিনের কাছে আব্বাসের কথা গুলো কেমন যেন লাগলো, ঠিক ভালো লাগলো না। তার ইচ্ছা হয় এখন এখান থেকে চলে যেতে, কিন্তু চলে গেলে লোকটা বলবে কী! বেয়াদবি হয়ে যাবে সেটা।
মন্টু যেন সঠিক সময়ে, সঠিক কাজটি করার জন্যই উপস্থিত হলো বারান্দায়। যেন শৌখিনকে আব্বাসের কাছ থেকে চলে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতেই সে এসেছে। মন্টু বারান্দায় বসে গলা ছেড়ে ডাকলো,
"ভূত ভায়া, ওইখানে কী করেন? এইদিকে আসেন। কাজ আছে।"
শৌখিন সুযোগটা হাত ছাড়া করলো না। সে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু যাওয়ার জন্য কয়েক পা এগোতেই আব্বাস বাধা দেয়। সে শৌখিনের সামনে এসে কাঁধে এক হাত রেখে তাকে থামালো। ফিসফিসে গলায় বললো,
"ধান্দা কইরা এই বাড়িতে না থাইকা, দ্রুত চলে যান ভাইজান। সেটা আপনার জন্যও ভালো, আর বাকি সবার জন্যও ভালো। নইলে এমন অবস্থাও হতে পারে যে উইঠা দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও পাইবেন না।"
শৌখিন আব্বাসের হাতটা সরিয়ে নিলো। বললো,
"যার বাড়ি সে যদি চলে যেতে বলে, তাহলে নিশ্চয়ই চলে যাব, ভাই।"
শৌখিন হাসলো। শৌখিনের হাসি আব্বাসের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিলো। শৌখিন পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আব্বাস পিছনে বসে কটমট করে বললো,
"শালা হারামির জাত।"
______________
গাছে গাছে পাখি ডাকছে। কাল সন্ধ্যা রাতে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর, এখন পর্যন্ত আর বৃষ্টি হয়নি। সূর্যটা উঁকি দেবে দেবে ভাব। একটুর মধ্যেই সূর্যটা হয়তো তার সোনালী আলো নিয়ে উদয় হবে।
বাড়ির পিছনে কত গুলো হাঁস-মুরগি নিজেদের খাদ্যদ্রব্য ভাগবাঁটোয়ারা করে খাচ্ছে।
সাবের সাহেব গিয়েছেন কৃষি ক্ষেতে। হেলেনা থালা বাসন ধুচ্ছে। পারভেনু বিবি নিজের রুমে বসে কুরআন তিলাওয়াত করছেন। মন্টু, ঝন্টু আর চাঁদনী এখনও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সাব্বির গিয়েছে বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে। সাথে আব্বাসও আছে। সকাল বেলা হাঁটলে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে।
সানজুর ঘুমটা আজ খুব ভোরেই ভেঙ্গে গেল। ঘুমানোর শত চেষ্টা করেও আর ঘুমাতে পারলো না। শেষে বিরক্ত হয়ে নেমেই গেল বিছানা ছেড়ে।
সানজু ব্রাশ নিয়ে বেরোলো ঘর থেকে। চুল দুই পাশে বেণুনি করা। এক হাত দিয়ে ব্রাশ করছে আর এক হাত দিয়ে একটা বেণুনি নাড়াচাড়া করছে।
সানজু এগিয়ে যেতে লাগলো কল পাড়ের দিকে।
কলপাড় থেকে কিছুটা দূরে এসে দাড়িয়ে পড়ল সে। কলপাড়ে শৌখিন!
যবে থেকে শৌখিন এসেছে, তবে থেকে সানজুর কল পাড়ে আসা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। যে সময়ই আসে সেই সময়েই দেখে শৌখিন দাঁড়ানো। সানজু আজকে আর কলপাড়ের রাজত্ব শৌখিনের উপর ছেড়ে দিয়ে, পুকুরে চলে যাবে না। সে এগিয়ে গেল টিউবওয়েলের দিকে।
কোমরে এক হাত ঠেকিয়ে দাঁড়ালো সানজু। বিরক্ত থাকা সত্ত্বেও একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
"আপনি কল পাড়টা নিজের নামে কিনে নিয়েছেন না কি? যে সময়েই আসি, সে সময়েই দেখি আপনি এখানে। সকাল বেলা এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কি আর কোনো কাজ কর্ম নেই আপনার? না কি, আমি যাতে কল পাড়ে পা না রাখতে পারি সেজন্য উপস্থিত থাকেন? কোনটা? প্রতিজ্ঞা করেছেন আমায় কলপাড়ে আসতে দেবেন না বলে?"
"নাহ, আমি তো এমন কোনো প্রতিজ্ঞা করিনি। আর কারো কলপাড়ে আসায় বাধাও তো দিইনি। তোমার কেন মনে হচ্ছে যে, আমি এসব করার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছি?"
সানজু কষ্ট করে মুখে যে একটু হাসি ধরে রেখেছিল, তা নিমেষেই বিলীন হয়ে গেল। মুখটা কঠিন হয়ে গেল তার। কোমর থেকে হাতটা আপনা আপনি সরে গেল। রাগে চাপা কণ্ঠে বললো,
"কী? কী বললেন আপনি? 'তুমি'? আপনার সাহস কত বড়ো! এরই মধ্যে 'আপনি' থেকে 'তুমি'তে নেমে এসেছেন? কত বড়ো বেয়াদব হলে আপনি এটা করতে পারেন! কোন সাহসে...কোন সাহসে আপনি আমায় তুমি করে বললেন? এ বাড়িতে আশ্রিত হয়ে আছেন সেটাই কি যথেষ্ঠ নয়?
আমার সাথে খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করবেন না একদম। ফারদার যদি শুনি আপনার মুখ থেকে 'তুমি' শব্দ বের হয়েছে, তাহলে আপনাকে এ বাড়ি ছাড়া করতে আমার দুই মিনিটও লাগবে না।"
"আপনি এরকম করছেন কেন? 'তুমি' শব্দটা কি এতটাই খারাপ? যদি এতই খারাপ হয় তাহলে আপনার বোন কেন বললো তুমি করে বলতে?" শৌখিন সহজ ভাবে জানতে চাইলো।
"বেয়াদবের পাশাপাশি আপনি যে কত বড়ো মিথ্যাবাদী, সেটার প্রমাণও দিয়ে দিলেন। আমার বোনের তো খেয়ে-দেয়ে কোনো কাজ নেই ও আপনাকে 'তুমি' বলা শেখাবে!
হাহ্, ভালোই। ভালোই মিথ্যা বলতে পারেন আপনি। আপনাকে কি অস্কার ছুঁড়ে মারবো?"
"মিথ্যা বলছি না, সত্যিই উনি..."
শৌখিনকে পুরো কথা শেষ করতে দিলো না। তার কথার মাঝেই সানজু বললো,
"ব্যস, চুপ করুন। আর কান খুলে শুনে রাখুন, এরপর মনের ভুলেও কখনো তুমি করে বলবেন না আমায়। খবর আছে তাহলে।"
"তাহলে কী বলবো?"
" 'আপনি' শুধুই 'আপনি' করে বলবেন। আর যদি সেটা করতে না পারেন, তাহলে এর ব্যবস্থাও আমি নেবো।"
সানজু কটমট করতে করতে চলে গেল কলপাড় থেকে।
শৌখিন অবাক হয়ে ভাবলো,
"...'তুমি' বলা এতটাই খারাপ?...কিন্তু তেমনটা তো মনে হয় না!"
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ০৯ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
আজ আব্বাসের চলে যাওয়ার দিন। এই দুই দিন সানজুর সাথে দেখা হলেও তেমন কথা হয়নি তার। সানজু শুধু এড়িয়ে যাওয়ার বাহানা খুঁজতো। তাই আব্বাস ঠিক করলো আজ কথা বলেই যাবে। আব্বাস সানজুর রুমের সামনে এলো। দরজা ভিতর থেকে আটকে রেখেছে সানজু। আব্বাস দরজায় হাত দিয়ে কয়েকটা চাপড় মারলো আস্তে। ভিতর থেকে সানজুর গলা শোনা গেল,
"কে?"
আব্বাস বললো,
"আমি। দরজা খোলো।"
আব্বাসের গলা শুনে সানজুর বিরক্ত, রাগ দুটোই হলো। বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
"আমি বই পড়ছি। আপনি পরে আসেন।"
আগের মতোই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো সানজু।
আব্বাস বললো,
"না, না পরে না। পরে আর দেখার সময় থাকবো না। আজকেই চলে যাব আমি। তুমি দরজা খোলো। ঢাকায় যাওনের আগে তোমার চাঁদ মুখখানা দেইখা যাই।"
সানজু বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। কয়েকটা গালিও দিলো অস্ফুট স্বরে। তারপর নিজেকে শান্ত করে ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে নিলো। দরজা খুললো গিয়ে। দরজা খুলতেই আব্বাসের মুখে হাসি ফুঁটলো। সানজুকে দেখে বললো,
"এই যে, তোমার চাঁদ মুখখানা দেখলাম, অহন আমার জীবন স্বার্থক।"
আব্বাস রুমের ভিতর ঢুকলো। এমন হুটহাট করে ওর রুমে কেউ ঢুকে যাক সেটা পছন্দ না সানজুর। সানজু বললো,
"আপনাকে না বলছি আমার রুমে যখন তখন হুট হাট করে ঢুকে যাবেন না। আমার রাগ হয়।"
আব্বাস বললো,
"এত রাগের কী আছে? তোমার হুবু স্বামীই তো ঢুকছে। ঠিক আছে বাদ দিই এসব। তুমি কও, ঢাকা থেইকা কী নিয়া আসমু তোমার জন্য? কী লাগবো তোমার?"
সানজু চোখ মুখ কঠিন করে বললো,
"কিচ্ছু লাগবে না আমার।"
"ঠিক আছে, বুঝতে পারছি। তোমার কিছু বলা লাগব না। আমি নিজেই পছন্দ কইরা সব নিয়া আসবো তোমার জন্য।"
আব্বাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে সানজুর একটুও ভালো লাগছে না। সানজু বললো,
"যদি আপনার কথা শেষ হয়ে থাকে তাহলে যান। আমি পড়তে বসবো।"
সানজুর কথায় আব্বাস অসন্তুষ্ট হয়। আব্বাস গলা চড়াও করে বললো,
"এত পড়ালেখা কইরা কী হইবো? সেই তো আমার ঘরে গিয়া ভাত তরকারি-ই রাঁধতে হইবো। এত লেখা পড়ার কী দরকার?"
তারপর আবার, কণ্ঠ মোলায়েম করে বললো,
"এত দূরের পথ ঢাকা যাইতেছি, একটু ভালো বিদায় তো দাও।"
কথাটা বলেই আব্বাস হুট করে সানজুর এক হাত ধরে বসলো। সানজু চমকে উঠলো!
সানজু তীব্র রাগ নিয়ে বললো,
"কী করছেন, আব্বাস ভাই? হাত ছাড়েন!"
"যদি না ছাড়ি?...কয়দিন পর তো এই হাত আমারই হইয়া যাইবো।" আব্বাস হাসলো।
আব্বাসের হাসি দেখে সানজুর পিত্তি জ্বলে গেল। সানজু নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। সানজু রাগে, ক্ষোভে দিশেহারা হয়ে বললো,
"আব্বাস ভাই, হাত ছাড়েন! ছাড়েন বলতেছি! নইলে কিন্তু আমি..."
"কী করছেন এখানে?"
সানজু পুরো কথা শেষ করার আগেই দরজার কাছ থেকে বলে উঠলো একটা শান্ত কণ্ঠ।
সানজু তাকালো দরজার দিকে। আব্বাসও ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরলো।
শৌখিনকে দেখেই আব্বাসের মুখ থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে এলো,
"শালা বেজন্মা!"
আব্বাস আবার সানজুর দিকে ফিরলো। সানজুর হাত শক্ত করে চেপে ধরলো রাগে। সানজুর মনে হলো ওর রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আব্বাস কটমট করে বললো,
"এই পোলারে তাড়াতাড়ি ভাগাও বাড়ি থেইকা, নইলে কিন্তু আমার হাতে খুন হইয়া যাইবো। কেউ টেরও পাবা না।"
আব্বাস ছেড়ে দিলো সানজুর হাত। সানজু তাড়াতাড়ি অপর হাত দিয়ে আলতো করে ধরলো সেই হাতটা। লাল হয়ে গেছে হাত।
আব্বাস সানজুর রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একবার জ্বলন্ত চোখে তাকালো শৌখিনের দিকে। শৌখিনও তাকালো। শৌখিনের চোখের দৃষ্টি বরাবরের মতো শান্ত। শৌখিন একটু মৃদু হাসলোও। আব্বাস চোখ সরিয়ে নিয়ে হন হন করে করে চলে গেল। শৌখিন তাকিয়ে রইল আব্বাসের যাওয়ার পথে। আব্বাস চোখের আড়াল হলে, তাকালো সানজুর দিকে। সানজু হকচকিয়ে গেল। কী করা উচিত এখন ওর? কী বলা উচিত?
সানজু এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললো,
"ধন্যবাদ!"
শৌখিন কিছু বললো না। চলে গেল নির্লিপ্তকার ভাবে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় আবার থামলো। পিছন ফিরে তাকালো সানজুর রুমের দরজার দিকে। সাথে সাথে সানজু লুকিয়ে পড়লো আড়ালে। শৌখিন না চাইতেও তার ঠোঁট প্রশস্ত হলো। সে আবার হাঁটতে লাগলো।
সানজু আবার উঁকি দিলো দরজা দিয়ে। দেখলো শৌখিন হেঁটে যাচ্ছে। সানজুর শৌখিনের ডান হাতটা খেয়াল হলো। সানজু চোখ সরু করে বিড়বিড় করে বললো,
"কী ওটা?...কদম গাছের পাতা? সিরিয়াসলি! লোকটার মাথা কি সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে গেল না কি? কদম গাছের পাতা নিয়ে কেন ঘুরে বেড়াচ্ছে?"
_______________
ভিতর থেকে কেটে গেল কয়েকটা দিন।
মন্টু এক গাদা কাপড় চোপড় নিয়ে পারভেনু বিবির ঘরের দিকে এগোচ্ছে। পারভেনু বিবি জানালার ধারে চেয়ারে বসে আছেন। মন্টু পিছন থেকে ডাকলো,
"আম্মা।"
পারভেনু বিবি জবাব দিলেন না।
মন্টু আবার ডাকলো,
"আম্মা!"
পারভেনু বিবি এবার জবাব দিলেন। মন্টুর দিকে ফিরে বললেন,
"কী? সমস্যা কী তোর?"
মন্টু হাতের জামা কাপড় সব বিছানার উপর ফেলে বললো,
"আমার জামা কাপড় ধুয়ে দাও।"
পারভেনু বিবি আকাশ থেকে পড়ার মতো করে বললো,
"অ্যাঁ? কী করমু আমি?"
"জামা কাপড় ধুয়ে দাও।"
পারভেনু বিবি গলা খাঁকারী দিয়ে বলে উঠলেন,
"বাইর হ তুই আমার রুম থেইকা... দুই দিন পর পর মানষের ওনার জামা কাপড় ধুইয়া দেওয়া লাগবো, কী শখ! হেই দিনও দেখলাম তোর জামা কাপড় ঝুলতেছে ছাদে। আইজকা আবার আইছো জামা কাপড় ধোঁয়াইতে? তোর সমস্যা কী? আমি জিগাই তোর সমস্যা কী?"
মন্টু বিরক্ত হয়ে বললো,
"এত প্যাঁচাল রাখো। ধুয়ে দিবা না কি সেটা বলো?"
"না, দিবাম না।"
"সত্যিই দিবা না?"
"কইলাম তো, না। এমনিতেই কোমর ব্যথার জ্বালায় বাঁচি না, আবার ওর জামা কাপড় ধুইয়া দিবাম! তোর জামা কাপড় ধোয়ন কি আমার কাম?"
পারভেনু বিবির কথা বলতে দেরি হলো, কিন্তু মন্টুর বিছানা থেকে কাপড় চোপড় গুটিয়ে রুম থেকে বেরোতে সময় লাগলো না।
মন্টু খানিক ইতস্তত করে এবার এলেন হেলেনার কাছে। হেলেনা মন্টুর হাতে জামা কাপড় দেখে বললেন,
"কী মন্টু মিয়া, শার্ট-প্যান্ট নিয়া ঘুইরা বেড়াও কেন?"
"না ঘুইরা বেড়িয়ে আর উপায় কী? যে পরিমান ময়লা হইছে! রীতিমতো দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।"
"দাঁড়াও, দাঁড়াও, ময়লা হয়ে গেছে মানে কী? কয়েক দিন আগেই তো কত গুলো ধুয়ে দিলাম। আর এগুলো তো সব সময়ের পড়ার জামা না যে, পরতে পরতে ময়লা হয়ে গেছে। একদিনও তো এই শার্ট-প্যান্ট পরতে দেখলাম না তোমারে।"
"দেখবা কী করে, তোমরা সবাই তো থাকো চোখ বুজে। গত পাঁচ ছয় মাস ধরে আমি এগুলো পরছি।"
হেলেনা হেসে দিলো।
"পাঁচ-ছয় মাস?"
হেলেনার হাসি যেন থামছে না।
"এগুলো তো আমি তিন, চার দিন আগেই ধুয়ে দিলাম।
আচ্ছা বলো তো, তুমি ধোওয়া জামা কাপড় আবার কেন ধুইতে আসছো? ও বুঝতে পারছি, কালকে পাত্রী দেখতে যাচ্ছি বলে চকচক করা জামা আরও চকচক করতে চাও? যাতে পাত্রী ঝন্টুরে পছন্দ না করে তোমায় করে সেজন্য..."
"ফালটু কথা বইলো না ভাবী। আমি দেখতে এমনিতেই সুন্দর। পাত্রীর যদি পছন্দ করার হয় তাহলে এমনিতেই করবে। সেজন্য চকচকে জামা লাগবে না। আমার চকচকে মুখ খানির কাছে সব চকচকে তুচ্ছ। হুহ্!"
মন্টু মুখ বেজার করে চলে গেল।
আর কোনো মানুষ পেল না বলে মন্টু নিজেই, সাবান, ডিটারজেন্ট, বালতি, ব্রাশ নিয়ে পুকুর ঘাটে চললো। চাঁদনী আর সানজু থাকলে অবশ্য ওদের হাতে গছিয়ে দিতো। ওরা নিশ্চয়ই ওদের প্রাণের কাকাকে ফিরিয়ে দিতো না! কিন্তু আফসোস ওরা এখন নেই। স্কুলে আছে।
মন্টু শার্ট-প্যান্ট সব আগে বালতির ভিতর পানি দিয়ে ভিজালো। তারপর একটা শার্ট উঠিয়ে সাবান ঘষে কাচঁতে শুরু করলো। এসব শার্ট প্যান্ট ধুতে যে কী কষ্ট! ঘাম বের হচ্ছে শরীর থেকে।
কিছুক্ষণ পর ঘাটে আগমন ঘটলো শৌখিনের। শৌখিন উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"কী করছেন, ভাই?"
"জামা কাপড় ধুই। দেখতেই পাচ্ছেন।"
"একার করতে কষ্ট হচ্ছে?"
"তাতো হচ্ছেই, ভূত ভায়া।"
"আমি সাহায্য করবো?"
"সাহায্য করবেন? হ্যাঁ, করতে পারেন। কিন্তু খুব কষ্টের কাজ কিন্তু।"
"সমস্যা নেই।" শৌখিন হাসতে হাসতে ঘাটের উপর বসলো।
মন্টুকে দেখে দেখে কাপড়ে সাবান ঘঁষে কাচঁতে লাগলো।
সাবের সাহেব প্রতিবেশী খায়রুল হকের বাড়ি গিয়েছিলেন। বাড়ির পিছন থেকে কতটুক দূরেই খায়রুল হকের বাড়ি। খায়রুল হকের বাড়ি থেকে ফিরে ঘাটে মন্টু আর শৌখিনকে দেখে থেমে গেলেন তিনি। শৌখিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এই কয়দিনে বেশ মানিয়ে নিয়েছে সকলের সাথে ছেলেটা। কে বলবে, যে ছেলেটা হুট করে কয়দিন আগে বৃষ্টির মাঝে কাদা মেখে উপস্থিত হয়েছে! দেখে মনে হয় যেন বহু বছর ধরে এই বাড়িতে আছে। সাবের সাহেবের অজান্তেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শৌখিনকে বড্ড আপন আপন মনে হয় সাবের সাহেবের। কিন্তু কেন? সেই উত্তর নেই সাবের সাহেবের কাছে।
সেদিনের পর আর কখনো ওই বিষয়ে কথা বলেননি সাবের সাহেব, শৌখিনের সাথে। পরিচয় পাওয়া যাক আর না যাক, তাতে কিছু যায় আসে তার। বরং এখন মনে হয় পরিচয় খুঁজে না পাওয়াতেই সে খুশি।
সাবের সাহেব চোখ সরিয়ে নিলেন ঘাটের উপর থেকে। বাড়িতে প্রবেশ করলেন।
_______________
বিকেল বেলার আকাশ ধবধবে পরিস্কার। কোনো মেঘ নেই। মনে হয় না আর বৃষ্টি নামবে। তবুও চাঁদনী কত গুলো ছাতা ঠিক করে রাখলো। কে বলতে পারে, আকাশ হয়তো আবার ধোঁকা দিয়ে, কালো হয়ে বৃষ্টি ঝরাতে শুরু করবে!
আজকে পাত্রী দেখতে যাওয়া হবে। মন্টুর জন্য নয়, ঝন্টুর জন্য। কিন্তু মন্টুর উদ্দীপনাই বেশি। সে এমন একটা ভাব করছে যেন তার জন্য দেখতে যাওয়া হচ্ছে। সেই দুপুর থেকে দৌঁড়া-দৌঁড়ি লাগিয়েছে। সাজগোজ নিয়েও তার জিজ্ঞাসাবাদের শেষ নেই। কিছুক্ষণ পর পরই সানজু আর চাঁদনীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে,
'কেমন লাগছেরে আমায়?'
'এই শার্ট-প্যান্টে সুন্দর দেখাচ্ছে?'
'আরে, ওই চাঁদনী দেখ ভালো করে। পাউডার বেশি হয়ে গেল না কি?'
'কোন বুট জোড়া পরলে ভালো লাগবে রে? এইটা? না কি এইটা?'
'পারফিউম দেওয়া একটু কম হয়ে গেছে, না রে? আর একটু দেবো?'
'আরে, ওই সানজু পাউডার কি ঘেমে উঠছে? একটু খেয়াল টেয়াল রাখ।'
সানজু মন্টুর এমন কারবার দেখে বললো,
"মন্টু কাকা, তুমি তো এমন করছো যেন তোমার জন্য মেয়ে দেখতে যাওয়া হচ্ছে। পছন্দ হলে আজই বিয়ে করে নিয়ে আসবে। আর ওদিকে দেখো। ঝন্টু কাকা হাঁদারামের মতো বসে আছে।"
"আরে রাখ ওর কথা। আমার দিকে দেখ। সব কিছু ঠিকঠাক আছে না?"
চাঁদনী পাশ থেকে বললো,
"ঠিকই আছে। তবে যদি তোমায় একটু চোখে কাজল পরিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে আরও ভালো লাগতো। বেশ মানাতো তোমায়। এর পাশাপাশি যদি মাশকারা, হালকা লিপস্টিক, আইলাইনার দিয়ে দেওয়া যেতে, তাহলে তো আরও ভালো হতো।"
মন্টু চিন্তিত গলায় বললো,
"তাই না কিরে? ছেলেদেরও এসব দিলে ভালো লাগে?"
চাঁদনী জোর দিয়ে বললো,
"লাগে বৈ কি! তুমি দেবে?"
মন্টু হেসে বললো,
"ধ্যাৎ! কী বলিস? মেয়ে হয়ে যাব না কি?"
সানজু বললো,
"আরে দাও না মন্টু কাকা। ভালো লাগবে।"
মন্টু ম্লান কণ্ঠে বললো,
"থাক, দরকার নেই।"
তারপর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা শৌখিনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
"আমায় এমনিতে দেখতে সুন্দর লাগছে না, ভূত ভায়া?"
শৌখিন মৃদু হেসে বললো,
"হুম। শুধু সুন্দর নয়, খুব সুন্দর লাগছে।"
মন্টু খুশি হলো। কেমন একটা গর্ব বোধ হচ্ছে তার।
সানজু আনমনে তাকিয়ে ছিল শৌখিনের দিকে। শৌখিন ওর দিকে তাকানোয়, খেয়াল হতেই চোখ নামিয়ে ফেললো। মনে মনে নিজেকে একটা গালি দিলো। সানজু ইদানিং খেয়াল করছে, শৌখিনকে কেন জানি আর আগের মতো খারাপ লাগে না ওর কাছে। উল্টো তাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে মনে হয়...
কথাটা মনে হতেই সানজুর কেমন যেন লাগলো। ইশ! দিনকে দিন এমন হচ্ছে কেন? নিজেকে কেমন বেহায়া, বেহায়া মনে হচ্ছে!
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ১০ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
পাত্রীর বাড়ি।
জমিদার বাড়ির একটা রীতি আছে, যদি কারো বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা হয়, তাহলে পরিবারের সবার যেতে হবে। সেই দরুন হিসাবে সবাই-ই উপস্থিত আছে এখানে। সাবের সাহেব, হেলেনা, পারভেনু বিবি, সানজু, চাঁদনী, মন্টু, ঝন্টু, এমনকি শৌখিনও। শুধু উপস্থিত নেই সাব্বির। তার আবার এসব ভালো লাগে না। তাই সে আসেনি।
এর ভিতরে মন্টুর অবস্থা দেখার মতো। সে কিছুক্ষণ পর পর পাত্রীকে দেখছে, মিটি মিটি হাসছে, আবার নিজে কেমন একটা ভাব নিয়ে বসছে। চাঁদনী কিছুক্ষণ মন্টুর এমন অবস্থা দেখে সানজুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
"এবারও একটা কেলেঙ্কারি হবে রে আপু। পাত্রী বোধহয় মন্টু কাকার পছন্দ হয়ে গেছে! ঝন্টু কাকার বিয়ে এবারও হবে না।"
সানজু আস্তে করে বললো,
"আহ্, থাম। শুধু দেখ।"
চাঁদনী সোজা হয়ে বসলো।
পাত্রী মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। এত লোকের সামনে বসতে যে তার কিছুটা লজ্জা করছে, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কথাটা মনে হতেই মন্টু মনে মনে হাসলো। তারপর পাশের চেয়ারের কাছে মাথা এগিয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
"আচ্ছা ভূত ভাই, বলেন তো পাত্রীকে কার সাথে বেশি মানায়? আমার সাথে, না কি ঝন্টুর সাথে?"
শৌখিন একটু চিন্তা করে বললো,
"দুজনের সাথেই মানায়।"
"উহ, আমি সেটা বোঝাইনি। আমি জানতে চাইছি কার সাথে বেশি ভালো মানায়? যেমন একটা ব্যাপার আছে না, যে দেখলেই মনে হয় এদের জুটি একেবারে স্বর্গ থেকে ফিক্সড করা। তো পাত্রীকে কার সাথে দেখলে অমনটা মনে হয়?"
শৌখিন অনিশ্চিত গলায় বললো,
"সেটা তো ঠিক জানি না, ভাই।"
মন্টু অখুশি হলো। এখানে না জানার কী আছে? পাত্রীকে তার সাথে সবচেয়ে বেশি ভালো মানাবে, এটা তো একেবারে স্পষ্ট। মন্টু মনে মনে ঠিক করলো, কিছুতেই এই মেয়ের বিয়ে ঝন্টুর সাথে হতে দেওয়া যাবে না। পরিবারের লোককে পটিয়ে ফটিয়ে ঠিকই সে নিজে বিয়ে করে নেবে।
কিছুক্ষণ পর পাত্রী দেখার কাজ সম্পন্ন হলো। পাত্রী সবার পছন্দ হয়েছে। ঝন্টুর সাথে বেশ মানাবে বলে সবার বিশ্বাস। কিন্তু মন্টু মনে মনে ক্ষুব্ধ। তার ধারণা, বাড়ির কারোর চোখ ঠিক নেই। তা না হলে কি তাকে রেখে ঝন্টুর সাথে মানায় এসব বলে বেড়াতো!
মন্টু মনে মনে বাড়ির লোকজনদের হাজারটা কথা শুনালেও, মুখে কুলুপ এঁটে রইল। কিছু বলবে না সে এখন। আগে বাড়ি যাক সেখানে গিয়েই যা বলার বলবে সব। সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে আসল সত্যিটা।
সবাই পাত্রীদের টিনের ছাউনি ওয়ালা বিশাল ঘরটা থেকে বের হলো। বাড়িতে মোট পাঁচটা ঘর। বিশাল বড়ো উঠোন। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। সবার মাথার উপরই ছাতা। মন্টু আর শৌখিন এক ছাতার নিচে। আর সানজু আর চাঁদনী এক ছাতার নিচে। বাকি সবাই আলাদা। উঠোন পিচ্ছিল হয়ে গেছে বৃষ্টির কারণে। মনে হচ্ছে একটু অসাবধান হলেই পড়ে যেতে হবে। পায়ের উপর ভর দিয়ে ভীষণ সাবধানে পা ফেলছে সবাই। মন্টু এর মধ্যেই পা পিছলে পড়ে যেতে নিয়েছিল। কিন্তু শৌখিনকে আঁকড়ে ধরে নিজের পতন ঠেকালো। মন্টুর এমন কাণ্ড দেখে কোনো এক ঘরের বারান্দায় বসে হেসে উঠলো একটা মেয়ে। মন্টুরও চোখ পড়ল সেদিকে। মন্টুর রাগে শরীর জ্বলে গেল। এমনিতেই তার মেজাজ খারাপ, তার উপর আবার তাকে নিয়ে হাসাহাসি! মন্টু মনে মনে কয়েকটা কড়া কথা শোনালো মেয়েটাকে।
উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় উঠে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো সবাই। ইটের রাস্তা। দুটো রিজার্ভ অটো দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ সাবের সাহেবদের অপেক্ষায় ছিল তারা। একটা অটোতে, সানজু, চাঁদনী, মন্টু আর শৌখিন উঠলো। অন্যটাতে সাবের সাহেব, ঝন্টু, হেলেনা আর পারভেনু বিবি। অটো ছেড়ে দিলো। ইটের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছে অটো। রাস্তা খারাপ থাকায়, মাঝে মাঝে ঝাঁকি খেয়ে উঠছে অটো। এক পাশের সিটে সানজু, চাঁদনী আর অন্য পাশে মন্টু, শৌখিন। সানজু শৌখিনের দিকে তাকিয়ে আছে। শৌখিন চাঁদনীর সামনা-সামনি বসা। শৌখিনের চোখ বাইরের প্রকৃতির উপর নিবদ্ধ। কিন্তু এক জোড়া চোখ যে তার উপর নিবদ্ধ সেটা সে খেয়াল করলো না। অন্য কেউও খেয়াল করলো না।
_______________
বাড়ীতে এসে যে যার রুমে যাওয়া দিলেই মন্টু বললো,
"দাঁড়াও সবাই।"
দাঁড়ালো সকলে। সবাই আন্দাজ করতে পারলো মন্টু ঠিক কী বলবে। পারভেনু বিবি বিরক্ত হয়ে বললো,
"কী? তোর কী হইলো আবার?"
মন্টু বললো,
"আম্মা, তোমাদের সবার কি চোখ খারাপ হইছে? এমন উল্টা কাজ তোমরা কীভাবে করবা?"
"কী উল্ডা কাম?" পারভেনু বিবির প্রশ্ন।
"এই যে, তোমরা ওই মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক না করে, ঝন্টুর সাথে ঠিক করছো! তোমাদের কি আক্কেল জ্ঞান নাই? ওই মেয়েকে কার সাথে ভালো মানায়? আমার সাথে না কি ঝন্টুর সাথে?"
মন্টুর গলায় বেশ জোর টের পাওয়া গেল।
চাঁদনী মুখে হাত দিয়ে হাসলো। সত্যি সত্যি আবার কেলেঙ্কারি লেগেছে!
সাবের সাহেব মন্টুর কথার গোড়া ধরতে পেরে বললেন,
"যথেষ্ট হয়েছে মন্টু, যথেষ্ট। এই নিয়ে ছয়বার হলো। এবার আর কোনো ঝামেলা বাঁধাস না।"
"না, ভাইজান। যথেষ্ট হয়নি। ওই মেয়ের সাথে কিছুতেই তোমরা ঝন্টুর বিয়ে দিতে পারবে না। যদি দিতে হয় তাহলে আমার সাথেই দিতে হবে। আর যদি এর ব্যতিক্রম ঘটে, তাহলে আমি বাড়ি থেকে চলে যাব।"
সাবের সাহেব কঠিন গলায় ডাকলো,
"মন্টু!"
"যত যাই বলো না কেন, কাজ হবে না। আমি যাব তো যাবই, কেউ খুঁজেও পাবে না।" মন্টুর গলায় দৃঢ়তা অটল।
সাবের সাহেব দমে গেলেন। উনি জানেন মন্টু যখন বলেছে বাড়ি থেকে চলে যাবে, তখন যাবেই। এর আগে পাঁচবার মেয়ে দেখতে যাওয়া হয়েছে ঝন্টুর জন্য। কিন্তু মেয়ে দেখতে গেলে সে মেয়ে পছন্দ হয় মন্টুর। যেদিন প্রথম মেয়ে দেখতে যাওয়া হয়েছিল, সেদিন সেই মেয়ে পছন্দ হয়েছিল মন্টুর। তারপর বাড়িতে এসে সে কী ঝামেলা! সেদিন মন্টু বলেছিল, সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে যদি ঝন্টুর সাথে বিয়ে হয়। বাড়ির সবাই খুব রাগ দেখিয়ে ছিল সেদিন, মন্টুর এমন অবাধ্যতার জন্য। কিন্তু মন্টু সত্যি সত্যিই সেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। প্রথমে কেউ পাত্তা দেয়নি। ভেবেছিল কতক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করে ঠিকই আবার বাড়ি আসবে। কিন্তু মন্টু এলো না। তার পর দিন সকালে সাবের সাহেব খোঁজ নিতে বের হলেন। কোনো খোঁজও পেলেন না। বাড়িতে কান্নার রোল পরে গেল। পারভেনু বিবি কেঁদে কেটে বাড়ি ঘর মাথায় তুললেন। অবশেষে তিন দিন পর বাড়ি ফিরলো মন্টু। কেউ কিছু বলারও সাহস পায়নি তাকে আর।
দ্বিতীয় মেয়ে দেখার সময়ও একই ঘটনা ঘটলো। বাড়িতে এসে ঝামেলা লাগলো। মন্টু বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। এলো না পাঁচ দিনেও। কোন এক বন্ধুর বাসায় থেকেছিল। ছয়দিনের মাথায় এসেছিল বাড়িতে।
এর পরের বার এমন কিছু হওয়ার আগেই সাবের সাহেব সামলিয়ে নিয়েছিলেন ব্যাপারটা। যে বাড়িতে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলেন, সে বাড়িতে সম্বন্ধ করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর যেখানেই মেয়ে দেখতে গেল, সেখানেই ঘটতে লাগলো এক কাহিনী। মেয়ে পছন্দ হয়ে যেত মন্টুর। কিন্তু জমিদার বাড়ির কেউ সেটা মেনে নিলো না। যেখানে বড়ো ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে যাওয়া হয়েছে, সেখানে ছোট ছেলের বিয়ে তারা দেবে না কিছুতেই। সেটা ভীষণ লজ্জাজনক মনে হয় তাদের কাছে। আবার ঝন্টুর আগে মন্টুর বিয়েও দেবেন না তারা। সবাই ঝন্টুকে বড়ো, আর মন্টুকে ছোট হিসেবেই মানে। বড়ো ছেলের আগে ছোট ছেলের বিয়ে দিলে লোকে কী বলবে?
তাই এভাবেই চলতে লাগলো। কিন্তু ঝন্টুর জন্য পাত্রী দেখতে গেলে, সেই পাত্রী মন্টুর পছন্দ হওয়া যেন একটা অসুখের মতো। যে অসুখ কিছুতেই ভালো হয় না।
সাবের সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন,
"ঠিক আছে, দেখি কী করতে পারি। এখন এই বিষয়ে কেউ আর কিছু বলবে না।"
সবাই মেনে নিলো সাবের সাহেবের কথা। সাবের সাহেব নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।
কয়েক দিন পর সাবের সাহেব যে বাড়িতে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলেন সে বাড়িতে জানিয়ে দিলেন, তারা তাদের সাথে সম্বন্ধ করবেন না।
মন্টুর মনে একটু দুঃখও হলো, আবার আনন্দও হলো। দুঃখ হলো কারণ, মেয়েটাকে সে পছন্দ করে এসেছে কিন্তু বিয়ে করতে পারলো না। অবশ্য তাতে তার খুব বেশি একটা যে দুঃখ লাগছে সেটাও না। এমন তো আগেও ঘটেছে, তাই বিষয়টা স্বাভাবিক তার কাছে। আনন্দ যদি হয় দশ ভাগ, সেখানে দুঃখ হলো দুই ভাগ।
অন্যদিকে বিয়ে ভাঙলো, কী বিয়ে ঠিক হলো, তাতে ঝন্টুর কিছু আসে যায় না। অবশ্য কী-ই বা আসবে যাবে তার! সে যে কত ভোলা ভালা! এর আগে যে পাত্রী নিয়ে ক্যাচাল হলো তা নিয়েও ঝন্টু কিছু বলেনি। একটা টু শব্দও করেনি। কোনো কিছু নিয়েই মাথা ঘামায় না সে। কী হলো, কী না হলো কোনো কিছু নিয়েই ভাবে না সে। জীবন তো চলেই যাচ্ছে। এত ভাবাভাবির দরকার কী?
______________
আজকে সারাদিনে বৃষ্টি হয়নি। আকাশ পরিস্কার। আকাশে বড়ো একটা চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার চাঁদ না হলেও অনেকটা বড়োই। চাঁদের মিষ্টি আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। নাকে ভেসে আসছে নানান ফুলের সুবাস। বইছে ঝিরিঝিরি বাতাস। কী রোমাঞ্চকর পরিবেশ!
চাঁদনী বড়ো করে একটা নিঃশ্বাস নিলো। এরই মধ্যে এসে উপস্থিত হলো শৌখিন। এসে চাঁদনীর থেকে কিছুটা দূরে মেঝেতে পাটির উপর বসলো। চাঁদনী শৌখিনকে দেখেও কিছু বললো না। শৌখিনও বললো না কিছু।
শৌখিন চাঁদের আলোয় দেখতে লাগলো সামনের পরিবেশ। কদম গাছ দুটো ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। কদম গাছের মাঝে ফুল গুলোকে মনে হচ্ছে, প্রহরীর মতো। যেন গোটা একটা সবুজ রাজ্যকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব তাদের উপর। শৌখিন মুচকি হাসলো। তবে সব থেকে আজব ব্যাপার হলো, এই কদম ফুল গুলো শৌখিনের খুব প্রিয় হয় সত্ত্বেও, সে এই ফুলের নাম জানে না। এ কদিনে যে কারোর কাছে জিজ্ঞেস করেই তো নাম জেনে নেওয়া যেত। তাহলে? কাউকে জিজ্ঞেস করেনি কেন?
শৌখিন কদম গাছের দিকে তাকিয়ে থেকেই চাঁদনীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
"আচ্ছা, ওই ফুল গুলোর নাম কী?"
চাঁদনী আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদটাকে দেখছিল। শৌখিনের প্রশ্নে, শৌখিনের দিকে তাকালো। অবাক হয়ে জানতে চাইল,
"কোন ফুলের কথা বলছেন?"
শৌখিন নিজের দৃষ্টি কদম গাছের উপর রেখেই বললো,
"ওই যে সাদা, হলদে রঙের, গোল গোল ফুল গুলো!"
চাঁদনী বুঝতে পারলো শৌখিন কদমের কথা বলছে। চাঁদনীর গলায় রাজ্যের বিস্ময় উপচে পড়লো,
"এমা! আপনি জানেন না এই ফুলের নাম কি? বাংলাদেশের জনগণ আর কোনো ফুল চিনুক আর না চিনুক, এই ফুল তো সবাই চিনবে বলে আমার ধারণা ছিল। কিন্তু আপনি..." চাঁদনী একটু থামলো। তারপর আবার বললো,
"আচ্ছা, আপনার ব্যাপারটা কী বলুন তো? সেদিন জিজ্ঞেস করলেন 'আচার' কী জিনিস। আজ জিজ্ঞেস করছেন এই ফুলের নাম কী! আমার তো সন্দেহ হচ্ছে, আপনি আসলেই এই গ্রহেরই তো?"
চাঁদনী একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলো শৌখিনকে।
শৌখিন একটু চমকালো। তারপর চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
"আমি তো আপনার সামনেই বসে আছি, আমাকে দেখে কী মনে হয়? আমি কি ভিনগ্রহের প্রাণী?"
সানজু সেদিন কলপাড়ে বসে শৌখিনকে 'তুমি' বলা নিয়ে কথা শোনানোর পর, শৌখিন আর চাঁদনীকেও তুমি করে ডাকেনি। চাঁদনী সব শুনে মেনে নিয়েছিল, 'আপনি' ডাক। যদিও এখনও 'আপনি' করে বললে তার নিজেকে বুড়া বুড়া লাগে।
চাঁদনী বললো,
"কে জানে! দেখতে তো মানুষের মতোই। এখন ভিনগ্রহের প্রাণী না কি সেটা কী করে বলবো? শুনেছি, ভিনগ্রহের প্রাণীরাও না কি মানুষের মতো দেখতে হতে পারে!"
শৌখিন জোরে হেসে দিলো চাঁদনীর কথা শুনে। এমন ভাবে হাসছে যেন, চাঁদনী কোনো জোকস শুনিয়েছে। পৃথিবীর বিখ্যাত জোকসের একটা যেন সে চাঁদনীর মুখে শুনলো।
চাঁদনীর খারাপ লাগলো, শৌখিনকে এভাবে হাসতে দেখে। সে বললো,
"কী ব্যাপার! এভাবে হাসছেন কেন? আমি কি কোনো মজার কথা বলেছি? না কি বোকার মতো কথা বলেছি? আপনি কি আমায় কটাক্ষ করছেন?"
শৌখিন হাসি থামালো। চাঁদনীর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। নিজে আবার কদম গাছের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
"ফুল গুলোর নাম কী?"
"কদম।" চাঁদনী সোজা উত্তর দিলো।
"কদম!" অস্ফুট স্বরে একবার আওড়ালো শৌখিন।
কিছুক্ষণ চুপ থাকলো দুজন।
এক সময় শৌখিন বললো,
"আপনার নাম 'চাঁদনী' কেন রাখা হলো? দেখতে চাঁদের মতো সুন্দর বলে?"
শৌখিনের কথায় অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো চাঁদনী।
পরক্ষণেই আবার চোখ সরিয়ে নিলো। লজ্জা লাগছে চাঁদনীর। কেউ তাকে চাঁদের মতো সুন্দর বলছে, ইশ!
শৌখিন আবার বললো,
"আচ্ছা, আপনার বড়ো বোনের নাম সানজু কে রাখলো?" শৌখিন এমন ভাবে কথাটা বললো যেন, সানজুর নাম 'সানজু' হওয়া ঠিক হয়নি।
চাঁদনী জিজ্ঞেস করলো,
"এমন ভাবে কথাটা বললেন কেন? কেন, আপুর নাম কী অন্যকিছু হওয়া উচিত ছিল?"
শৌখিন মাথা দুলিয়ে বললো,
"হু।"
"কী হওয়া উচিত ছিল?"
"কদম রানি।"
চাঁদনী হেসে ফেললো শৌখিনের কথায়। হাসতে হাসতে বললো,
"কেন, ওর নাম কদম রানি হওয়া উচিত ছিল কেন?"
"এই যে, উনি কদমদের উপর শাসন করে বেড়ায়। কেউ ওনার কদম ফুলের গায়ে হাত দিলে, সে প্রচুর ক্ষেপে যায়। যে ব্যক্তি কদম ফুল ছোঁয়, সে ব্যক্তির হাত সুস্থ স্বাভাবিক থাকবে না বলে হুমকি দেয়। সেজন্যই ওনার নাম হওয়া উচিত ছিল, 'কদম রানি'।"
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ১১ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
কিছুক্ষণ আগেও আকাশে চাঁদ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এখন আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি হবে কী হবে না ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বাইরে বাতাস বইছে। গাছ গুলো হেলেদুলে উঠছে বাতাসে।
চাঁদনী আইসক্রিম চুষতে চুষতে সানজুর রুমে প্রবেশ করলো। তার হাতে সানজুর জন্য আরেকটা আইসক্রিমের প্যাকেট। সানজু বিছানায় শুয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিল। জহির রায়হানের লেখা, 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসটা। চাঁদনী যে রুমে ঢুকলো সেদিকে তার খেয়াল নেই। চাঁদনী বিছানার পাশে বসে বললো,
"উঠো, কদম রানি। আইসক্রিম খাও। নয়তো কিছুক্ষণ পর আর আইসক্রিম পাবে না, গলে সব পানি হয়ে যাবে।"
চাঁদনীর কথা শুনে সানজু দড়াম করে উঠে বসলো। চাঁদনীর দিকে অবাক দৃষ্টি মেলে বললো,
"ওই, 'কদম রানি' কী রে?"
"ওমা! তুই জানিস না? কাদা ভূত তো তোর নতুন নামকরণ করেছে! তুই কদমদের উপর শাসন করে বেড়াস, কদম ধরতে দিবি না বলে হুমকি দিস, সেজন্য উনি তোর নাম, 'কদম রানি' রেখেছে।" কথাটা বলে চাঁদনী হেসে উঠলো।
সানজুর একটু রাগ হলো। লোকটা এমন ভাবে মজা করলো ও কে নিয়ে। হাসির পাত্র বানালো?
সানজু চাঁদনীর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললো,
"হাসি থামা। আর কাদা ভূতকে গিয়ে বল, ওনাকে আমার নামকরণ করতে হবে না। আমার এমনিতেই সুন্দর একটা নাম আছে। আমি ওনার মতো বেনামি না।"
চাঁদনী হাসি থামালো। সানজু আইসক্রিমের প্যাকেট থেকে আইসক্রিম বের করতে করতে বললো,
"আইসক্রিম কই পাইছিস?"
"মন্টু কাকা আনছে, বাজার থেকে।"
চাঁদনী কয়েক মিনিট চুপ থেকে হঠাৎ করে বললো,
"আপু, লোকটা কিন্তু আসলেই সন্দেহজনক! একটু ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যায় সেটা। তোর ধারণা সত্যিই ছিল।"
"তাই? তুই কী করে বুঝলি? খেয়াল করে দেখেছিস?"
"আরে, লোকটা দু দিন আজব আজব কথা জিজ্ঞেস করেছে আমায়!"
সানজু একটু বিস্মিত চোখে তাকালো চাঁদনীর দিকে।
"কী আজব কথা বলেছে?"
"একদিন আমায় জিজ্ঞেস করলো, 'আচার' কী জিনিস। আজকে যখন আমি বারান্দায় বসে ছিলাম, তখন আবার কদম ফুলের কথা জিজ্ঞেস করলো। বললো, 'ওই ফুল গুলোর নাম কী?'
আচ্ছা আপু তুই-ই বল, একটা মানুষ আচার আর কদম ফুল না চিনে পারে কী করে?"
সানজু কিছু বললো না। চিন্তিত ভাবে আইসক্রিমের গায়ে কামড় বসালো।
চাঁদনী আবার বললো,
"আর সব থেকে অবাক বিষয় কী, জানিস?"
"কী?"
"উনি আমায় আজকে জিজ্ঞেস করেছেন, 'আষাঢ়ের আর কত দিন বাকি আছে?'
এত কিছু জানার থাকতে উনি এই আজব প্রশ্ন কেন করলেন? তাও আবার কোনো কথাবার্তা নেই, হঠাৎ করে!" চাঁদনীর চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট।
"তুই কী উত্তর দিয়েছিস?"
"আমি বলেছি, 'আছে বেশ কয়েকদিন, কেন?'।"
"উনি কিছু বলেননি?"
চাঁদনী দুই পাশে মাথা নেড়ে বললো,
"না। গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবলো, তারপর হেসে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। বিশ্বাস কর আপু, ওই সময় ওনাকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল।"
"অন্যরকম মানে?" উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলো সানজু।
"কেমনই যেন লাগছিল, ঠিক বোঝাতে পারব না। চিন্তিত...কেমনই যেন!"
সানজু আর কিছু বললো না। চাঁদনী কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললো,
"আরও একটা ব্যাপার কী, জানিস?"
"কী?"
"যেদিন উনি প্রথম এসেছিলেন সেদিন আমি ঝন্টু কাকার থেকে শুনেছিলাম। উনি না কি বলেছিলেন, বাংলা ভাষা উনি আগে না জানলেও এখন জানেন। মানে আমাদের আব্বা তৃতীয় বার কথা বলার পর না কি ওনার বাংলা ভাষা আয়ত্ত হয়ে গেছে!"
সানজুর ভ্রু যুগল আপনা থেকেই কুঁচকে উঠলো।
চাঁদনী বললো,
"এটাই বলেছেন উনি।"
সানজু কিছু বলতে পারলো না। চিন্তায় পড়লো সে। যদিও আগেও চিন্তা ছিল শৌখিনকে নিয়ে। কিন্তু, এখন সেই চিন্তা আর এই চিন্তার মাঝে বিরাট ফারাক। সানজু শুধু মনে মনে প্রশ্ন গেঁথে গেল। লোকটা আসলে কে? কোত্থেকে এসেছে? কী নাম? কেমন মানুষ? ভয়ংকর? না কি ভালো?
_____________
শেষ রাতের দিকে ঝড় হয়েছিল। সানজুর কয়েকটা ফুল গাছ ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। সেই নিয়ে সানজুর মনে খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু বাকি গাছ যে ঠিক আছে সেই ভেবেই আবার স্বস্তি!
সানজু কষ্ট ভরা মন নিয়ে কল পাড়ের দিকে যেতে লাগলো। কল পাড় খালি। সেদিনের পর আর কখনো শৌখিনকে দেখা যায়নি কলপাড়ে। সানজু মুখ ধুয়ে বাড়ি এসে নাস্তা করলো। আজ ছুটির দিন। স্কুলে যেতে হবে না। নাস্তা শেষেই চাঁদনী দুইটা ঝুড়ি নিয়ে হাজির হলো। সানজু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"ঝুড়ি দিয়ে কী করবি?"
"আম কুড়াতে যাব। কালকে ঝরে আম তলায় নিশ্চয়ই অনেক আম পড়েছে। মানুষজন টের পেলে এসে চুরি করে নিয়ে যাবে!"
"নেবে না। আমাদের গাছের আম অন্য মানুষ কেন নেবে?"
"না নেবে না! গতবারও তো মুন্সি বাড়ির মেয়ে গুলো এসে নিয়ে গেল। ভুলে গেছিস সব?"
সানজু কথা বাড়ালো না, ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। যাওয়ার সময় মন্টু কাকাকে ডেকে গেল। কিন্তু সে গেল না।
বাড়ি থেকে কতক দূরেই ক্ষেতের পাশে আম গাছ। পরপর চারটা গাছ। গাছে গুলোতে দেরিতে আম ধরে। বাড়ির ভিতর যে আম গাছ গুলো আছে, সে গাছের আম জ্যৈষ্ঠ মাসের ভিতরেই পেঁকে যায়। আষাঢ় মাসে গাছ গুলোতে আমের ছিটে ফোঁটাও খুঁজে পাবে না কেউ। শুধু ওই চারটা গাছেই আম আছে এখনও। দূরে বসেই দেখা যাচ্ছে আম পড়ে আছে গাছের তলায়।
চাঁদনী দৌঁড়ে গেল। দ্রুত আম কুড়িয়ে ঝুড়িতে ভরতে শুরু করলো। সানজুকেও তাড়া দিয়ে বললো,
"আরে তাড়াতাড়ি আয়, আপু। কিছুক্ষণ পরই দেখবি ওই মুন্সি বাড়ির মেয়ে গুলো এসে হাজির হয়েছে। এসে হাত বাড়িয়ে সব আম নিয়ে যাবে, কিছু বলতেও পারবি না। ওদের যে ত্যাড়া বাঁকা কথা! আস্ত দজ্জাল একেকটা।"
সানজু অত তাড়া দেখালো না। সে ধীরে সুস্থে আম কুড়াতে লাগলো। নিজেদের গাছের আম কেন অন্যের ভয়ে দ্রুত কুড়াতে হবে?
শৌখিন দূরে বসে সানজু আর চাঁদনীকে দেখে এগিয়ে এলো। শৌখিনকে দেখে চাঁদনী বললো,
"আরে হাত লাগান না, মিয়া। সারাদিন তো শুয়ে বসে থাকেন। একটু কাজও করেন।"
শৌখিন হাসতে হাসতে দু পায়ের উপর ভর করে বসে, সানজু, চাঁদনীর সাথে আম কুড়াতে শুরু করলো। হেসে জিজ্ঞেস করলো,
"...'মিয়া' কী জিনিস?"
সানজুর আম কুড়ানো থেমে গেল।
চাঁদনী উত্তর দিলো,
"আপনার মাথা।"
"মাথাকে মানুষ 'মিয়া' বলে?" জানতে চাইলো শৌখিন।
চাঁদনী একটা আম প্রায় ছুঁড়ে ফেললো ঝুড়িতে। তারপর শৌখিনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
"সত্যি করে বলুন তো কোত্থেকে এসেছেন আপনি?"
শৌখিন একটু ভাবার মতো করে বললো,
"উম...হতে পারে আকাশ থেকে টুপ করে পড়েছি, আবার হতে পারে হাওয়ার তরে ভেসে ভেসে দৃশ্যমান হয়েছি!" কথাটা বলে শৌখিন নিজেই হেসে দিলো।
চাঁদনী আর শৌখিনের থেকে সানজু কিছুটা দূরে। শৌখিনের হাসির মাঝেও অদ্ভুত রকমের এক ভিন্নতা খুঁজে পেল সে। যদিও শৌখিনের ওই ধোঁয়াশা মাখা মুখে কিছুই স্পষ্টতা পায় না। তবুও বেশ অনুভব করা গেল সেই ভিন্নতা। চাঁদনী খেয়াল করলো কী না কে জানে?
চাঁদনী শৌখিনের থেকে চোখ সরিয়ে আম কুড়াতে শুরু করলো আবার। বিরক্ত গলায় বললো,
"আপনি দিনকে দিন বিরক্তিকর হয়ে উঠছেন।"
শৌখিন আবারও হাসলো চাঁদনীর কথায়।
কিন্তু এবার আর কিছু বললো না।
চাঁদনীর ঝুড়ি আগে পূর্ণ হলো। চাঁদনী ঝুড়ি নিয়ে চলেও গেছে অনেকটা দূর। সানজু সবে ঝুড়ি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়ে আবার থামলো। পিছন ঘুরে শৌখিনের দিকে তাকালো। সানজুর এমন হঠাৎ করে তাকানোতে শৌখিন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। হাসার চেষ্টা করলো শৌখিন। সানজু ভালো করে শৌখিনের মুখটা দেখলো। কিছু একটা ধরার চেষ্টা করলো। কিন্তু শৌখিনের হাসি মাখা মুখের পিছনে কিছু প্রকাশ পেল না। সানজু ব্যর্থ ভাবে চোখ সরিয়ে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো।
______________
আজকে সারাদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। বৃষ্টি নামেনি। গরমও পড়েছে। হঠাৎ করে এমন গরম পড়ার কারণ জানা নেই সানজুর। সানজু ক্ষেতের পাশের আম গাছ গুলোর দিকে যাচ্ছে। গরমে ঘরের ভিতর বসে থাকা যায় না। আম তলায় বাতাস থাকে অনেক। চাঁদনীকে ডেকেছিল নিজের সাথে, কিন্তু চাঁদনী 'রূপা' নামের এক বান্ধবীর বাসায় দৌঁড় পেরেছে।
সানজু আম গাছের শিকড়ের উপর দাঁড়ালো গাছের সাথে হেলান দিয়ে। এখানটায় ভীষণ বাতাস। এখন আর গরম অনুভূত হচ্ছে না।
কেটে গেল খানিকটা সময়। হঠাৎ কারো আগমন ঘটলো আম তলায়। আগন্তুক ব্যক্তি এসে সানজুর পাশে দাঁড়ালো। একেবারে পাশে নয়, একটু দূরে। সানজু তাকিয়ে দেখলো, শৌখিন!
শৌখিন কিছু বললো না। সানজুর দিকে তাকালোও না। সে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে একটু দূরেই বিশাল মাঠ। মাঠে গরু বাধা। গরু গুলো ঘাস খাচ্ছে। শৌখিন মৃদু হাসলো। কেন যেন প্রকৃতি দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগে। শৌখিন আর একটু বেশি হাসলো। হঠাৎ তার মনে হলো কেউ একজন তাকিয়ে আছে তার দিকে। শৌখিন পাশ ফিরে চাইলো। সানজু হকচকিয়ে গেল। ইতস্তত করে চোখ সরিয়ে নিলো।
শৌখিন বললো,
"ওভাবে তাকিয়ে ছিলেন কেন? কিছু বলবেন?"
সানজু আবার তাকালো শৌখিনের দিকে। উদ্বিগ্ন হয়ে বলেই ফেললো,
"কে আপনি? কোত্থেকে এসেছেন?"
শৌখিন একটু হাসলো। বললো,
"আপনারা সবাই কেন এই একই প্রশ্ন করছেন? আমি তো বলেইছি..."
"মনে না পড়ার সস্তা বাহানা দেবেন না। আমি আগেই বলেছি আমি খুব ভালো করেই জানি আপনি কিছুই ভুলে যাননি।" শৌখিনের কথা শেষ করতে না দিয়ে বললো সানজু।
"তাহলে কী মনে হয়? আপনি মনে করছেন আমি নাটক করছি?"
সানজু সঙ্গে সঙ্গে কিছু উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ বাদে বললো,
"খুব ভালো অভিনয় করেন আপনি!"
শৌখিন আবারও হাসলো।
"খুব ভালো অভিনয়ই যদি করি, তাহলে কীভাবে ধরলেন যে আমি নাটক করছি? ভালো অভিনয় করলে নিশ্চয়ই সেটা বোঝার উপায় থাকা উচিত না!"
"যে যত ভালো অভিনয়ই করুক না কেন, মানুষের চোখ ফাঁকি দেওয়া সম্ভব না। অভিনয়ের মাধ্যমে কেউ কখনো কারো চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। সত্যি প্রকাশ পায়ই। মানুষের চোখ ফাঁকি দেওয়া ভীষণ কষ্টকর। মানুষের কাছ থেকে কিছুই লুকায়িত থাকে না। আপনার আসল পরিচয়ও লুকায়িত থাকবে না। আজ হোক, কাল হোক, হোক অন্য আরেকদিন, আপনার আসল পরিচয় প্রকাশ পাবেই। তাই সেই দিনটাকে এত দীর্ঘ করে লাভ কী? আজই বলে দিন না, ঠিক কে আপনি?"
"আমি কে সেটা জানার জন্য এতটা ব্যাকুল কেন আপনি? জানলে আমায় বাড়ি থেকে বের করে দেবেন?"
"না, বাড়ি থেকে বের করে দেবো না। আমি শুধু নিজের জানার কৌতূহলকে দমিয়ে রাখবো। তাই বলুন আমাকে, কে আপনি? একদিন হয়তো সকল মানুষই জেনে যাবে ঠিক কে আপনি। তাই সেটা যদি একটু আগে আমি জেনে যাই, তাহলে সেটা কি খুব বড়ো ভুল হবে?"
"যদি আমিই মানুষকে কিছু না জানাই, তাহলে কারো কিছু জানার ক্ষমতা নেই। কেউ কিছু জানতে পারবে না।"
"যদি আপনি না জানালে কেউ কিছু নাই জানতে পারে, তবে আপনি-ই জানিয়ে দিন। বলুন আমায়, কে আপনি?"
সানজুর গলায় প্রবল মিনতি।
শৌখিন সানজুর দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
"আপনি কিন্তু খুব কঠিন মানুষ..."
"আপনি তার থেকেও কঠিন!" শৌখিনের কথা শেষ হতে না হতেই বললো সানজু।
শৌখিন অবিশ্বাস্য ভাবে চোখ সরিয়ে নিলো সানজুর থেকে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বড়ো করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।
সানজু তাকিয়ে রইল শৌখিনের দিকে। আর শৌখিন তাকানো অন্যদিকে।
অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরও কিছু বললো না শৌখিন। আকাশ কালো হয়ে আসতে শুরু করলো। বাতাস আরও জোরে বইতে শুরু করেছে। একটু পরই বোধ হয় বৃষ্টি নামবে। শৌখিন সানজুর দিকে না তাকিয়েই শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলো,
"আষাঢ়ের আর কতদিন আছে?"
"মনে হয় আর ষোলো, সতেরো দিন আছে। কেন জিজ্ঞাস করছেন? কী করবেন আষাঢ়ের কয়দিন আছে শুনে? আষাঢ়ের সাথে সম্পর্ক কী আপনার? শুনেছি আরও একদিন আপনি চাঁদনীর কাছে এই একই কথা জানতে চেয়েছেন। কী করবেন আষাঢ়ের হিসাব রেখে?" সানজুর গলায় উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেল।
শৌখিন কিছু বললো না। সানজু শৌখিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,
"জানেন আপনি কিন্তু এখন আর আগের মতো বোকা সোকা শৌখিনটি নেই। পুরোই অন্য একজনকে দেখতে পাচ্ছি আমি। নিজেকে সব সময় যেমন করে রাখতে চান, আসলে আপনি তেমন না!"
শৌখিন এবারও কিছুই বললো না। শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে রইল নীরবে। সানজু টের পেল বৃষ্টি নামবে। তাই বেশি কথা না বাড়িয়ে বললো,
"আমার মন সব সময় জানতে চাইবে আপনি কে! যদি আপনার কোনো দিন মনে হয় যে আপনার সত্যিটা বলার সময় হয়েছে, আপনি বলতে চান আমায়, তাহলে বলে দেবেন। আমি সবসময় প্রস্তুত থাকবো আপনার কথা শোনার জন্য।"
সানজু দ্রুত ঘরে ফেরার জন্য আমতলা ছাড়ল। আম তলা থেকে কিছু দূর আসতেই হঠাৎ বৃষ্টি নামলো। সানজুর বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে। তাই উপায় অন্তর না পেয়ে খুব দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো। এক প্রকার দৌঁড়ের মতো। কিন্তু কিছুটা সামনে এগোতেই কিছু একটা বৃষ্টিকে আড়াল করে নিয়েছে মাথার উপর থেকে। সানজু থেমে গেল। চকিতে তাকিয়ে দেখলো, শৌখিন নিজের গায়ে থাকা শার্টটা ওর মাথার উপর ধরে রেখেছে। সানজু বেশ অবাক হলো।
সানজুকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শৌখিন বললো,
"দৌঁড়াতে শুরু করুন। বৃষ্টি আরও জোরে আসবে মনে হয়।"
সানজু চোখ সরিয়ে নিলো। সামনের দিকে তাকিয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলো। সানজুর সাথে তাল মিলিয়ে শৌখিনও দৌঁড়াচ্ছে। আর হাত দিয়ে ধরে রেখেছে দুজনের মাথায় একটা শার্ট।
সানজু অনুভব করতে পারলো দৌঁড়ের সাথে সাথে তার মনের ভিতর কিছু একটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে অজানা এক অনুভূতি।
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ১২ ( Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
সানজু ভিজে গেছে। সানজুর থেকেও বেশি ভিজেছে শৌখিন। শৌখিনের গায়ের টি-শার্ট ভিজে চুপচুপ হয়ে গেছে। একটা শার্ট আর কী-ই বা বৃষ্টি আড়াল করবে।
শৌখিন ভেজা শার্টটা বারান্দার পাশে দাঁড়িয়ে নিংড়াতে লাগলো।
সানজু দ্রুত ভেজা কাপড় পাল্টাতে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল, শৌখিন শার্ট নিংড়াতে নিংড়াতে সানজুর উদ্দেশ্যে বললো,
"চিন্তা করবেন না, জ্বর আসবে না।"
সানজু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
"আপনি কী করে জানেন বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর আসে?"
শৌখিন বারান্দার দড়িতে শার্ট মেলে দিয়ে বললো,
"এটা আমার ধারণা। বৃষ্টিতে ভিজলে তো জ্বর আসে অনেকের।"
সানজুর ঠিক বিশ্বাস যোগ্য মনে হলো না শৌখিনের কথা। কিন্তু কথাটা তো চিরন্তন সত্য। এখানে অবিশ্বাসের কী আছে? না কি শৌখিনের 'ধারণা' কথাটি ঠিক বিশ্বাস হলো না? কোনটা? কিন্তু এটা তো একটা সিম্পল ধারণা! যে কেউই করতে পারে।
সানজু নিজের অহেতুক চিন্তা বাদ দিয়ে, শৌখিনকে প্রশ্ন করলো,
"আর আপনার? আপনার জ্বর আসবে না?"
শৌখিন হেসে বললো,
"বৃষ্টিতেই যার সব, তার আবার বৃষ্টিতে ভিজলে কী হবে?"
"বুঝতে পারলাম না আপনার কথা! " খানিক বিস্মিত হয়ে বললো সানজু।
"না বোঝারই চেষ্টা করুন।"
"কেন?"
"এমনি।"
"এমনি! সব কিছুই কি এমনি? আপনার এখানে আসা, থাকা এগুলোও কি এমনি?"
"কী মনে হয়?"
"কিছুই মনে হয় না, আবার অনেক কিছু হয়ও।"
"কী হয়?"
"আপনার কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে?"
"না। আমার কাছে কেন জবাবদিহিতা করতে হবে? আপনার ইচ্ছা হলে বলবেন না হলে বলবেন না।"
"আমিও আপনার ইচ্ছার অপেক্ষায় থাকবো। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি আপনি নিজের ইচ্ছায় আপনার আসল পরিচয় বলবেন আমাকে।"
সানজুর কথা শুনলেও কিছু বললো না শৌখিন। ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইল শূন্য দৃষ্টিতে। সানজু আর কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকলো।
শৌখিন ফ্লোর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, বাইরে নিক্ষেপ করলো দৃষ্টি। বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। ঝুম বৃষ্টি। শৌখিন হাত বাড়িয়ে দিলো বাইরে। বৃষ্টির পানি হাতে পড়ে আবার হাত বেয়ে নিচে পড়তে লাগলো। শৌখিন হাতটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বললো,
"সময় ঘনিয়ে আসছে ক্রমশ! এত তাড়াতাড়ি কেন সময়টা অতিবাহিত হতে হবে? এবারের সময়টা দীর্ঘ হলে হয় না? আষাঢ় আরও দীর্ঘ হোক!"
"ভূত ভায়া, কী বলছেন একা একা?"
মন্টুর কথায় শৌখিন ঘোর থেকে বের হলো। পিছন ফিরে মন্টুকে তার সব সময়ের শান্ত হাসি উপহার দিয়ে বললো,
"বৃষ্টি কতটা মনোরম হয় সেটাই বলছিলাম নিজেকে নিজে।"
মন্টু এগিয়ে এসে বললো,
"বৃষ্টি মনোরম সেটা ঠিক আছে। নিজে এভাবে ভিজছেন কেন? জ্বর হবে তো! হায় হায় জ্বর হলে কী হবে বলেন তো!" মন্টুর গলায় আকুলতা।
"বৃষ্টিতে না ভিজে কি বৃষ্টির মনোরমতা বোঝা যায়?"
"তাই বলে..." মন্টু কথা শেষ না করে আবার তাড়া দিয়ে বললো,
"চলেন, চলেন, আগে তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টান। জ্বরের শরীরে মায়া দয়া কিছুই নাই। তার হুট করে আসতেও সময় লাগবে না, মানুষকে কাবু করে বিছানায় ফেলতেও সময় লাগবে না।"
মন্টু শৌখিনকে ধরে নিজের সাথে নিয়ে গেল।
____________
রাত নেমেছে ইতোমধ্যে। বাইরে এখনও বৃষ্টি।
চাঁদনী পারভেনু বিবির রুমের সামনে থেকে যাচ্ছিল। পারভেনু বিবি রুমের ভিতর থেকে ডাকলো,
"চান্দু, আরে ওই চান্দু এদিকে আয়!"
'চান্দু' ডাকটা শুনেই চাঁদনীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে পারভেনু বিবির ঘরে ঢুকে বিরক্ত গলায় বললো,
"দাদি, তোমারে না বলছি আমায় চান্দু, চান্দু বলে ডাকবা না! তারপরও কেন ডাকো? চাঁদনী ডাকতে পারো না?"
"আরে যাহাই চাঁদনী, উহাই চান্দু। দুইটার ভিত'রে কোনো ফারাক নাই।"
"তোমায় বলছে? চান্দু কি চাঁদনীর সমার্থক শব্দ? কোথায় পাইছো তুমি? কোন বইতে লেখা আছে? আগে ছোট ছিলাম চান্দু, চান্দু ডাকছো মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন বড়ো হয়েছি, এখন আর কিছুতেই মানবো না।"
"আরে বড়ো হইছ তো কী হইছে? হাতে পায়ে লম্বা হইলেই কী আর হয়? আমগো কাছে তো অহনও ল্যাদা মাইয়াই রইয়া গেছো।"
চাঁদনীর মেজাজ আরও বেশি খারাপ হলো। কিন্তু নিজেকে শান্ত রেখে বললো,
"কীসের জন্য ডাকছো আমায়?"
"শোকেনরে একটু ডাইকা দে দেহি।"
"শোকেন? 'শোকেন' কী আবার?"
"আরে, তোর দাদার মতো দেখতে পোলাডার কথা কই।"
চাঁদনী বুঝতে পারলো পারভেনু বিবি শৌখিনের কথা বলছে। বললো,
"ওনাকে তুমি শোকেন কেন বলছো? ওনার নাম কী শোকেন? ইতোমধ্যে ওনার নামেরও বারোটা বাজিয়ে ফেলেছো?"
"ওই একটা হইলেই হইবো। তুই ডাইকা দে।"
"কেন, ওনাকে ডেকে দেব কেন? ওনাকে দিয়ে কী করবা তুমি?"
"আরে একটু গপ শপ করি।"
"ওরে আমার গপ শপ। যাদের নামই বলতে পারো না ঠিক মতো, তাদের সাথে আবার কীসের গপশপ? হুহ্!" চাঁদনী মুখ ভেংচিয়ে পারভেনু বিবির ঘর ছাড়লো।
শৌখিনকে ডাকলোও না, কিছু জানালোও না।
____________
ভাগ্যক্রমে সানজুর জ্বর দেখা দেয়নি। বৃষ্টিতে ভিজলে রাতের মধ্যেই জ্বরের আনাগোনা টের পাওয়া যেত। কিন্তু তা হয়নি। সকাল থেকে চাঁদনী, পারভেনু বিবি, মন্টু কাকাকে নিজের কপাল দেখিয়ে যাচ্ছে সানজু। সবাই কপালে হাত রেখে বলেছে, তাপমাত্রা ঠিক আছে। হয়তো বেশি ভেজেনি বলে জ্বর আসেনি। বেশি ভিজলে যে জ্বর আসতো সেটা নিশ্চিত।
সানজু পাখিদের খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে শৌখিনকে দেখছে। লোকটা কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সানজু আসার আগে থেকেই ওখানে দাঁড়ানো সে। একটা লোক এতক্ষণ কীভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে একরকম ভাবে? পা ব্যথা হয় না? আচ্ছা, লোকটার জ্বর আসেনি? সে তো বেশিই ভিজেছিল কালকে। তাহলে আসলো না কেন? এমন একটা প্রশ্ন মাথায় আসতেই সানজু নিজের প্রতিই নিজে বিরক্ত হলো। ইদানিং কেমন বোকা, বোকা টাইপের চিন্তা করছে সে। বৃষ্টিতে ভিজলেই কি আর কারো জ্বর আসে?
ঝন্টু কাকা আর চাঁদনীরই তো তেমন কিছু হয় না বৃষ্টিতে ভিজলে। অন্যদিকে সে আর মন্টু কাকা ভিজলেই হয়েছে! জ্বর, সর্দি, কাশি লেগেই থাকবে।
এক বছর মন্টু কাকা আর সে গিয়েছিল এক ফুফুর বাড়ি বেড়াতে। সেই বাড়ি থেকে আসার পথে নামে বৃষ্টি। ছাতা ছিল না সাথে। গাড়ি থেকে নেমেও অনেক দূর হেঁটে, তারপর বাড়ি ফিরতে হবে। গাড়ি থেকে নামার পর তারা একটা দোকানের ছাউনির নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। কিন্তু বৃষ্টি কমার নামগন্ধও ছিল না। কতক্ষণ আর এভাবে অপেক্ষা করা যায়? মন্টু কাকা এক সময় খুব দাপট দেখিয়ে বলেছিল,
'আরে চল। কিছুই হবে না। জ্বর তো দূরের কথা, হাঁচির বাপ দাদাকেই আসতে দেবো না ধারে কাছে।'
মন্টু কাকার কথা মতো বৃষ্টিতে ভিজেই বাড়ি ফেরা হলো সেদিন। পরদিন থেকে শুরু হলো, হাঁচির বাপ, দাদাদের আসা যাওয়া। একই সাথে দুজনেরই জ্বর হয়েছিল। সে এক শক্তিশালী জ্বর!
সানজু শৌখিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই ভাবছিল এসব। এর মাঝেই একটা শালিক পাখি কামড় দিলো তার আঙ্গুলে। হঠাৎ করে এমন হওয়ায় চমকে উঠলো সানজু। পরে যখন বুঝতে পারলো, তখন কয়েক খানা কথা শোনালো পাখি গুলোকে।
পাখিদের খাওয়া শেষ হলে সানজু খাঁচা নিয়ে নিজের ঘরে রেখে দিলো। তারপর সব কিছু গোছগাছ করে বের হলো স্কুলে যাওয়ার জন্য। চাঁদনীর গোছগাছ এখনও শেষ হয়নি। সানজু বাইরে এসে দেখলো শৌখিন এখনও কদম তলায় ঠিক আগের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সানজু এগিয়ে গেল শৌখিনের দিকে। গলায় অবিশ্বাস্য ভাব এনে বললো,
"বাবারে বাবা, একটা লোক এত দাঁড়িয়ে থাকে কী করে এক জায়গায়? পা ব্যথা হয় না আপনার? না কি রোবট আপনি? কোনো কিছু অনুভব করতে পারেন না।"
শৌখিন সানজুর দিকে তাকালো। বললো,
"মানুষের থেকে রোবটের জীবন খুব সহজ তাই না?"
"কীসব কথা বলছেন! এখানে জীবনের কথা আসছে কোত্থেকে? তাও আবার বোকার মতো। রোবটের আবার কিসের জীবন?"
শৌখিন চোখ সরিয়ে নিলো সানজুর থেকে। বললো,
"মানুষের জীবন হচ্ছে একটা কঠিন জিনিস। এটা খুব কঠিন। কারো কারো ক্ষেত্রে এর কঠিনতা আরও বেশি।"
কথাটা বলে শৌখিন আবার তাকালো সানজুর দিকে। সানজুকে একবার দেখে নিয়ে বললো,
"স্কুলে যাচ্ছেন?"
"হুম, যাচ্ছি। কিন্তু একটু আগে কী বললেন আপনি? শুনতে সহজই শোনালো, কিন্তু মনে হয় কঠিন কিছু বলেছেন!"
"সহজ কথাই বলেছি আমি।"
"আচ্ছা!"
সানজু হঠাৎ করে মনে পড়ার মতো করে বললো,
"ও আরেকটা কথা। আপনি আমার নাম, 'কদম রানি' দিয়েছেন কেন? হা? আবার বলেছেন, আমি না কি হুমকি দিই কদম ফুল ধরতে দেবো না বলে! কখন কাকে হুমকি দিয়েছি আমি?"
"একি! এরই মধ্যে ভুলে গেছেন? আপনি স্বয়ং নিজেই তো হুমকি দিলেন আমায়!"
সানজুর ঠিকই মনে আছে। তা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করলো,
"কবে?"
"যেদিন আমি আপনার বেঞ্চির উপর রাখা ফুল গুলো নিয়েছিলাম, সেদিন।"
সানজু অস্বীকার করে বললো,
"মিথ্যা কথা। আমি কখনো কাউকে হুমকি দিইনি।"
শৌখিন মুচকি হাসলো।
"কী ব্যাপার হাসছেন কেন? আমাকে হাসির পাত্রী মনে হয়?"
"আপনি কোনো কিছুই স্বীকার করেন না।"
"...'কোনো কিছু'? কত কী অস্বীকার করেছি আমি আপনার থেকে?"
"প্রথম যেদিন আমি কাদা মাখা অবস্থায় বারান্দায় বসে ছিলাম, তখন আপনি আমায় উঁকি মেরে দেখেছিলেন। সেটাও তো স্বীকার করেননি।"
সানজু এবারও অস্বীকার করে বললো,
"যা আমি করিইনি, তা স্বীকার করবো কেন?"
সানজু কথাটা বলে শৌখিনের থেকে চলে যেতে লাগলো। কিন্তু মাঝপথে আবার থামলো। আবার এলো কদম গাছের তলায়। দু পায়ের পাতায় ভর করে উঁচু হয়ে, কদম গাছের একটা নুইয়ে পড়া ডাল থেকে ছিঁড়ে নিলো দুইটা কদম। কদম দুইটা শৌখিনের হাতে দিয়ে বললো,
"আজ থেকে কদম ফুল ধরার অধিকার দিলাম আপনাকে। অধিকার দিলাম আমাকে কদম রানি বলারও।"
কথা গুলো বলে সানজু আর একটু সময়ের জন্যও দাঁড়ালো না। লম্বা পা ফেলে দ্রুত চলে গেল। শৌখিন সানজুর চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে হাসলো একটু। তারপর হাতে থাকা কদম ফুল দুটোর দিকে তাকিয়ে বললো,
"আসলেই একজন কদম রানি আপনি। আপনি এই কদমদের মতোই স্নিগ্ধ, শুভ্র, সুন্দর।"
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ১৩ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
"একটা অবজেকশন আছে, শৌখিন ভাই।"
শৌখিন প্লেটে রাখা আম থেকে এক টুকরো আম মুখে পুরে বললো,
"কী অবজেকশন, ভাই?"
সাব্বির বললো,
"ব্যাপারটা আমি আগেই নোটিশ করেছি, কিন্তু বলা হয়নি। ব্যাপারটা একটু লক্ষ্য করুন। আপনি আমাকে ডাকেন, 'ভাই'। যেমন একটু আগেই ডাকলেন। অপরদিকে আমাদের মন্টু কাকাকেও ডাকেন ভাই। ব্যাপারটা অগোছালো না? একেতো কাকাকেও ডাকেন ভাই, আবার ভাতিজাকেও ডাকেন ভাই। ব্যাপারটা কিন্তু অগোছালোই।"
"তো এখন কী করবো?" বার কয়েক চোখের পলক ফেলে বললো শৌখিন।
"মন্টু কাকাকে ভাই ডাকা বন্ধ করতে হবে।"
শৌখিন চিন্তিত গলায় বললো,
"ওনাকে ভাই না ডাকলে কী ডাকবো?"
"...'মন্টু কাকা' ডাকবেন আমাদের মতো।"
শৌখিন হেসে বললো,
"সেটা হয় না।"
"কেন হয় না?" অবাক হয়ে জানতে চাইলো সাব্বির।
"এতদিন ধরে যাকে ভাই ডাকছি, তাকে হঠাৎ করে কাকা ডাকবো কী করে? সেটা কেমন শুনায়?
তাছাড়া, মন্টু ভাই একদিন আমায় বলেছিলেন, ওনার না কি এমন সম্পর্কই ভালো লাগে। যেমন, আমি ওনাকে ভাই ডাকি উনিও আমাকে ভাই ডাকেন। আবার ওনার ভাতিজাকে আমি ভাই ডাকি, ওনার ভাতিজাও আমাকে ভাই ডাকে। অপরদিকে আবার ওনার বড়ো ভাইকে ডাকি 'আঙ্কেল'! এটা না কি একটা অন্যরকম সম্পর্ক। অগোছালো, বেমানান তারপরও জোরালো সম্পর্ক। আর তাছাড়া আমারও ওনাকে কাকা ডাকতে মোটেই ভালো লাগবে না। ভাই ডাকটাই আমাদের দুজনের সাথে যায়।"
সাব্বির মাথা চুলকে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললো,
"তাই না কি? আমার তো তেমন মনে হয় না!"
সাব্বির ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবতে লাগলো।
______________
সানজু গুনে গুনে পাঁচটা কদম ছিঁড়লো ডাল থেকে। পাতা সহ ছিঁড়েছে। কদম পাঁচটা নিয়ে ঘরের দিকে গেল। শৌখিনের রুমের সামনে এলো। দরজা ভেজানো। সানজু একটুখানি ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলো। না, নেই শৌখিন। সানজু রুমে ঢুকলো। রুমে তেমন কিছুই নেই। আগেকার জিনিস পত্রই সব। অগোছালো হওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। তবুও মনে হলো লোকটা বেশ গোছালো। তা না হলে বিছানার চাদর একটু হলেও এলো মেলো থাকতো, আলনার কাপড় গুলো এখানে সেখানে ভাঁজ বিহীন ঝুলতো, আর মশারি তো একবার টানালে খুলতই না!
সানজু টেবিলের কাছে গেল। টেবিলের উপর একটা জগ, আর একটা উপুড় করা গ্লাস। সানজু টেবিলের এক পাশে হাতের কদম গুলো রাখলো। তার নিচে একটা চিরকুট রাখতে গিয়ে একটু দ্বিধা হলো। ভাবলো, লোকটা পড়তে পারবে তো? সানজু কী যেন ভেবে চিরকুটটা রাখলো কদম গুলোর নিচে। তারপর বের হয়ে গেল রুম থেকে। দরজাটা টেনে বন্ধ করে রেখে গেল।
সন্ধ্যার সময় শৌখিন এলো নিজের রুমে। দুপুরে যে বের হয়েছে রুম থেকে, আর আসেনি। বিকেলে মন্টু, ঝন্টুর সাথে ঘুরে বেরিয়েছে রাস্তায়।
প্রথমেই শৌখিনের চোখ পড়ল টেবিলের উপর। কদম ফুল দেখে বেশ অবাক হলো। কে রাখলো? একটু ভাবতেই যেন আবার বুঝতে পারলো। শৌখিন এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। কদম ফুল গুলো উঠাতে নজরে পড়লো একটা সাদা ভাঁজ করা কাগজ। শৌখিনের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল বিস্ময়ে। শৌখিন কাগজটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুললো। কাগজের গায়ে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা-
'এই যে!
এই কদম পাঁচটা দেখছেন, এগুলো কেন দিলাম আপনাকে জানেন?
ঘুষ স্বরূপ দিয়েছি আপনাকে।
জানি না ঘুষ স্বরূপ আপনি কোন জিনিসটা বেশি পছন্দ করবেন। কিন্তু মনে হলো, কদমই বেশি পছন্দ করবেন। কারণ আমি আপনাকে পাগলের মতো কদম পাতা নিয়েও ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। তো, পছন্দ হয়েছে আমার দেওয়া ঘুষ?
যদি পছন্দ হয়, তাহলে কবে বলবেন আমাকে আপনার আসল পরিচয়? আজ? কাল? না কি অন্য একদিন?
আমি খুব করে জানতে চাই। আমার মন আকুল, ব্যাকুল দুটোই হয়ে আছে আপনার পরিচয় জানার জন্য। কবে বলবেন আমাকে?
শীঘ্রই বলবেন না কি দেরিতে?
দয়া করে জানাবেন আমায়। আমি অপেক্ষায় থাকবো।
ইতি-
আপনার আসল পরিচয় জানার জন্য আকুল, ব্যাকুল হওয়া মেয়েটি।'
শৌখিন সানজুর এহেন পাগলামি দেখে না হেসে পারলো না। নিজে নিজে বললো,
"মাথা খারাপ হয়ে গেছে না কি তার?"
শৌখিন আরও জোরে হেসে উঠলো।
_____________
মন্টু বড়ো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
"ঝন্টুর জন্য মেয়ে দেখতে গিয়ে, আমার পছন্দ হয়ে গেলে আমি কী করবো? আমি তো আর ইচ্ছে করে পছন্দ করি না। আমার পছন্দ হয়ে যায়। এতে আমার দোষ কী? কিন্তু যদি এরকমই চলতে থাকে তাহলে তো বিরাট সমস্যা! এতে জীবনে কি আর কারো বিয়ে হবে? ধ্যাত! ভূত ভাই, বলেন তো কী করা যায় এই সমস্যা থেকে বের হতে?"
শৌখিন একটু ভেবে বললো,
"আসলেই বড়ো একটা সমস্যা। কিন্তু এটা প্রতিকারে কী করবেন?...হ্যাঁ, একটা কাজ অবশ্য করা যায়, ভাই।"
"আচ্ছা! কী করা যায়?"
"আপনার ভাইয়ের আগে, আপনি বিয়ে করেন।"
মন্টু মুখ গোমড়া করে বললো,
"না ভাই, সেটা করা যাবে না। এটা আমি পছন্দ করি না। আর বাড়ির লোকও মানবে না। সুতরাং এটা করা যাবে না।"
"তাহলে আর কী করবেন?"
মন্টু করুণ চোখে তাকিয়ে বললো,
"সেটাই তো ভাই। কী করবো এখন? কোনো একটা বুদ্ধি দেন!"
শৌখিন ভেবে বললো,
"আর একটা কাজ করা যেতে পারে, ভাই?"
মন্টু উৎফুল্ল হয়ে বললো,
"তাই না কি? কী সেটা?"
"যেহেতু আপনার ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গেলে আপনার পছন্দ হয়ে যায়, সেহেতু আপনি পাত্রী দেখতে যাবেন না। পরশু তো আবার দেখতে যাওয়া হবে পাত্রী। ওই সময় যাবেন না আপনি।"
মন্টুর চেহারা একটু নিস্তেজ থেকে হঠাৎ চকচক করে উঠলো। সে শৌখিনের পিঠে চাপর মেরে বললো,
"সাবাশ, ভূত ভায়া! খুব ভালো একটা বুদ্ধি দিয়েছেন। ইশ! এত সহজ একটা সলিউশন আগে কেন মাথায় এলো না?
কারেক্ট, আমি পাত্রী দেখতে যাব না। ইনফেক্ট আমি ঝন্টুর বিয়ে হওয়ার সময়ও উপস্থিত থাকবো না। বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে আসার পরই আমি আসবো। তাহলে আর কোনো ঝামেলাই হবে না! কী বলেন ভূত ভাই?"
"কিন্তু বিয়ে করে নিয়ে আসার পর যখন দেখবেন, তখন পছন্দ হলে কী করবেন?"
মন্টুর চেহেরা আবার নিস্তেজ হয়ে পড়লো। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে ভাবলো। কিছুক্ষণ পর চেহেরা আবার হাস্যোজ্জ্বল হলো। মন্টু নিশ্চিন্ত গলায় বললো,
"সেটা হবে না। তখন সে অন্য একজনের বউ থাকবে। অন্য একজনের বউকে পছন্দ করা যায় না।"
"তাই?" শান্ত স্বরে জানতে চাইলো শৌখিন।
মন্টু মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হুম।"
তারপর বাইরের দিকে তাকিয়ে বললো,
"খুব ভালো বৃষ্টি হচ্ছে, ভূত ভায়া। শীতও পড়েছে। সময়টা ঘুমানোর জন্য বেশ উপকারী। আমারও ঘুমানো প্রয়োজন। ঘাড় থেকে কত বড়ো একটা দুশ্চিন্তা দূর হলো বলেন তো? নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দেওয়া প্রয়োজন এখন।"
মন্টু নাচতে, নাচতে বারান্দা ত্যাগ করলো। কোনো বিরাট বড়ো ঝামেলা থেকে মুক্তি পেলে যেমন আনন্দ হয়, তেমনি আনন্দিত মন্টু।
সানজু শৌখিনের সাথে কথা বলার জন্য এসেছিল। মন্টুকে শৌখিনের সাথে দেখে আর বারান্দায় যায়নি। এতক্ষণ হলরুমে বসেছিল। মন্টুকে নাচতে, নাচতে চলে যেতে দেখে এবার সে বারান্দায় এলো। পিছনে বসে কাশি দেওয়ার মতো করলো শৌখিনের মনোনিবেশ পাওয়ার জন্য। শৌখিন ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরলো। সানজুকে দেখে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সানজু দাঁড়ালো শৌখিনের পাশে এসে। শৌখিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে তাকালো। কী দেখছে লোকটা? বৃষ্টি দেখছে?
সানজু জিজ্ঞেস করলো,
"সব সময় বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকেন কেন? অনেক দিন দেখেছি আমি আপনাকে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে। বৃষ্টিতে ভিজতেও দেখেছি। তাও আবার রাতের বেলা। খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার অনেকক্ষণ পর আপনি বৃষ্টিতে ভেজেন। কেন? কেন করেন ওরকম? বৃষ্টিতে কী আছে? আর আষাঢ়! আষাঢ়ের সাথেই বা কী আছে? কেন জিজ্ঞেস করেন আষাঢ়ের আর কয়দিন আছে? সম্পর্ক কী এগুলোর সাথে আপনার?"
সানজুর কথা শৌখিনের কানে ঢুকলো ঠিকই কিন্তু কোনো রেসপন্স করলো না। সানজুর এই মুহূর্তে লোকটাকে বেয়াদব মনে হলো। আগের মতো হলে হয়তো লোকটাকে এখন এ নিয়ে কথা শোনাতো। কিন্তু এখন কেন যেন আর তা করতে মনে চায় না। মনে হয় লোকটা কষ্ট পাবে! আর নিজেরও খারাপ লাগবে।
অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরও যখন শৌখিন কিছু বললো না, তখন সানজু-ই আবার বললো,
"আপনার ঘরে যা রেখেছিলাম দেখেছেন তা?"
এবার শৌখিন কথা বললো। সানজুর দিকে না তাকিয়ে বললো,
"হুম দেখেছি।" তারপর সানজুর দিকে তাকালো। বললো,
"পছন্দ হয়েছে আপনার দেওয়া ঘুষ।"
"তাহলে কবে বলবেন আমাকে?"
"যদি বলি এই মুহূর্তে।"
সানজু হকচকিয়ে গেল।
"এখন?"
"কেন? এখন শুনতে অসুবিধা আছে?"
"না। কোনো অসুবিধা নেই। বরং সুবিধা আছে। বলুন আপনি।"
শৌখিন একটু হেসে চোখ সরিয়ে নিলো সানজুর থেকে। আবার বাইরে দৃষ্টিপাত করে বললো,
"না থাক, অন্য আরেকদিন বলবো।"
"কেন, অন্য আরেকদিন কেন? আজকে যদি না-ই বলবেন, তবে কেন বললেন এই মুহূর্তে বলবেন?"
"আমি তো কথা দিইনি। বলেছি, 'যদি'।"
"খুব কথা ঘোরান আপনি! আর পাকা পাকা কথা বলেন। আমি কিন্তু পাকা পাকা কথা বলা লোকদের পছন্দ করি না..."
সানজুর কথা শেষ হতে না হতেই শৌখিন চকিতে ঘুরে তাকালো সানজুর দিকে। শৌখিনের এমন করায় থতমত খেয়ে গেল সানজু। শৌখিন সানজুর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করছে। সানজু অবাক হয়ে শৌখিনের মুখের উপর দৃষ্টি বুলাতে বুলাতে বললো,
"কী দেখছেন?"
শৌখিন সানজুকে অবাক করে দিয়ে বললো,
"আপনি কি পছন্দ করেন আমায়?"
সানজুর চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। বিস্ময়ে বিমোহিত সে। বলে কী লোকটা! সানজুর হৃদয় অজানা কারণেই কাঁপতে লাগলো। যে কাঁপন স্পষ্ট ভাবে টের পাচ্ছে সে। গলাটাও যে ক্রমশ শুকিয়ে আসছে সেটাও টের পাচ্ছে। এমন কেন হচ্ছে? সানজু দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো শৌখিনের থেকে। শ্বাস প্রশ্বাসও বোধহয় কিছুটা দ্রুত চলছে!
সানজু নিজের অবিশ্বাস্য মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। লোকটা...লোকটা কী করে...উহ!
সানজু আর কিছুই ভাবতে পারছে না, মস্তিষ্ক শূন্য লাগছে।
শৌখিন সানজুকে দেখে অবাক। সে কেবল বললো,
"আপনি কী..."
এর মধ্যেই সানজু অবাক কাণ্ড করলো। দৌঁড়ে চলে গেল বারান্দা থেকে।
শৌখিন অবাক হয়ে বললো,
"কী হলো তার?"
সানজু নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দিয়ে বিছানার উপর শুয়ে পড়লো। অস্বাভাবিক রকমের অস্থির লাগছে। কী বললো লোকটা? পছন্দ? সানজু চোখ মুখ খিচে ফেললো অস্বস্তি, অস্থিরতায়।
_____________
বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। সেই চমকানির আলোতে রাতের পরিবেশ অদ্ভূত রকমের ভয়ংকর লাগছে। শৌখিন ধীর পায়ে বারান্দা থেকে বাইরে নামলো। বৃষ্টির শীতল ফোঁটা ভিজিয়ে দিতে লাগলো তাকে। বুকের ভিতরের অশান্ত ছটফটানি কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। অস্থিরতা কেবল বেড়েই চলছে। বুকের এক কোণে চিনচিনে ব্যথা থেমে থেমে জেগে উঠছে! এক অনিরাময় কষ্ট এটা! শৌখিন কণ্ঠে হাজারও আক্ষেপ নিয়ে বললো,
"ভেঙ্গে যেতে পারে না এই ধরা বাধা নিয়ম? পেতে পারি না একটা দীর্ঘ সময়? এবারের মতো এখানেই থেমে যেতে পারে না এই অনিশ্চয়তার বেড়াজাল?"
শৌখিন চোখ বন্ধ করে ফেললো। বৃষ্টির পানির সাথে, সাথে গাল বেয়ে চোখের অশ্রুও পড়তে লাগলো।
রাতের এই অদ্ভুত পরিবেশ ছাড়া কেউ জানলো না, কেউ দেখলো না, একটা মানুষ জীবনে এই প্রথম কাঁদলো!
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ১৪ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
মন্টু পাত্রী দেখতে যাওয়ার আগের দিন সবার কাছে বলে বেড়ালো, সে পাত্রী দেখতে যাবে না। কিন্তু পাত্রী দেখতে যাওয়ার দিনই শুরু হলো তার তান্ডব।
আগের দিন রাতে তার ভালো ঘুম হলো না। কেমন দিশেহারা লাগছিল। বুঝতে পারছিল না কেন এরকম হচ্ছে! কিন্তু পরে বুঝতে পারলো। আসলে তার পক্ষে পাত্রী দেখতে না গিয়ে ঘরে বসা থাকা সম্ভব নয়। কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই সে আজ সকাল থেকেই আবার আগের মতো দৌঁড়া-দৌঁড়ি শুরু করলো। খুব সকালে উঠে দশ-বারোটা শার্ট ইস্ত্রি করলো। তারপর একটা একটা করে গায়ে দিয়ে দেখলো, ঠিক কোনটায় বেশি ভালো মানায়। কিন্তু নিজে বুঝতে পারলো না। তাই শৌখিনকে ডেকে আনলো। পরপর সানজু, চাঁদনীকেও ডাকলো। সবার কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করা শেষে একটা ধূসর রঙের শার্ট বাছাই হলো।
মূল সাজ তো শুরু হলো দুপুরে ভাত খাওয়ার পর। সাজগোজের উপর কড়া নজর রাখতে আদেশ দিলো সানজু আর চাঁদনীকে। সাজতে, সাজতেই দেরি বাধিয়ে দিলো অনেক। সাবের সাহেব এ নিয়ে রাগারাগিও করলেন। মন্টু সেসব গায়ে মাখলো না। এসময় মাথা গরম করে লাভ নেই। সাবের সাহেব শেষমেশ অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে পড়লেন আগে। সাথে হেলেনা, পারভেনু, ঝন্টুকে নিয়ে গেলেন। তাদের অটো স্টার্ট দিয়ে চলেও গেল। তবুও মন্টুর সাজ শেষ হলো না। চাঁদনী তাড়া দিয়ে বললো,
"আরে মন্টু কাকা, তাড়াতাড়ি করো। রাতে গিয়ে উপস্থিত হবে না কি?"
মন্টু পারফিউম দিতে দিতে বললো,
"এই হয়ে গেছে।"
"তাড়াতাড়ি চলো।" আবারও তাড়া দিলো চাঁদনী।
মন্টু আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিয়ে বললো,
"হ্যাঁ, চল।"
সবাই বের হলো ঘর থেকে। অটোতে ওঠার আগে মন্টু সাব্বিরকে ভালো করে বুঝিয়ে বললো,
"শোন, ভালো করে ভিতর দিয়ে দরজা দিয়ে রাখবি। তোর তো আবার কোনো হুঁশ খেয়াল থাকে না। দেখা যাবে ঘুমিয়ে থাকবি, আর চোর ঘরে উঠে এদিক দিয়ে সব নিয়ে যাবে। ভালো করে দরজা দিয়ে রাখ। আমরা না আসা পর্যন্ত কেউ দরজা ধাক্কালেও খুলবি না। যত জরুরি কাজেই আসুক না কেন কেউ! বুঝেছিস?"
সাব্বির বাধ্য শিশুর মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
সাব্বিরকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে অটোতে উঠলো মন্টু। অটো ছেড়ে দিলো। সানজুর সামনে শৌখিন বসা। পুরো রাস্তা অস্বস্তিতে কাটলো সানজুর। এই লোকটার সামনা-সামনি হতেই যেন কেমন লাগে এখন। অস্বস্তি ঘিরে ধরে। সানজু কিছুতেই বুঝতে পারে না, লোকটা সেদিন হঠাৎ করে ওরকম একটা কথা কেন বললো?
সানজু জানে যে, সে হয়তো শৌখিনকে পছন্দ করে, আবার হয়তো না। কিন্তু সেটা সব সময় থাকে তার মনে, মনে। তাহলে লোকটা কী করে বুঝলো সেটা? ব্যাপারটা কি কোনো রকম ভাবে চোখে মুখে ফুঁটে উঠছে তার? কথাটা মনে হতেই লজ্জায় মাটির ভিতর ঢুকে যেতে ইচ্ছে হয় সানজুর। কী বড়ো অপমানজনক ব্যাপার! ইশ!
সানজু মাথা নিচু করেই বসে রইল সারা পথ। মাথা তুলে তাকাতে সাহস হলো না। আবার চোখে মুখে কী থেকে কী প্রকাশ পেয়ে যায় কে জানে!
শৌখিনও অটোতে বসে চুপচাপ থাকলো। সামনে সানজুকে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে খারাপ লাগলো তার। সে চায় না সানজু এরকম ভাবে থাকুক। সানজুকে আগে যেরকম ভাবে দেখেছে, সেরকম ভাবেই দেখতে চায়। সানজুকে এরকম থাকতে দেখে ভালো লাগে না তার, একদমই ভালো লাগে না!
পাত্রীর বাড়ির সামনে অটো থামলো। সবাই নামলো অটো থেকে। গেট পেরিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে চাঁদনী বললো,
"ভুল বাড়িতে চলে এলাম না তো, মন্টু কাকা? তুমি কি শিওর এই বাড়িটাই?"
"শিওর নাতো কী? দেখলি না আরও একটা অটো দাঁড় করানো?"
চাঁদনী আর কিছু বললো না। একটা বোকার মতো প্রশ্ন যে সে করে ফেলেছে, সেটা বুঝতে পারলো।
ঘরের ভিতর পা দিয়ে পাত্রীকে দেখেই মন্টু অস্ফুট স্বরে বলে ফেললো,
"সুবহানাল্লাহ!"
সানজু শুনতে পেল মন্টু কিছু একটা বলেছে। সানজু ফিসফিস করে জানতে চাইলো,
"কী বলছো, মন্টু কাকা?"
মন্টু সানজুর এক হাত ধরে কাছে এনে, কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
"এ মেয়েতো আসমান থেকে নেমে আসা পরীর মতো রে সানজু!"
সানজু মনে মনে প্রমোদ গুনলো। ঝন্টু কাকার বিয়ে বোধ হয় এবারও হলো না! আহারে, বেচারা ঝন্টু কাকা!
পাত্রীর বাড়ির লোক মন্টুদের বসার জন্য চেয়ার এগিয়ে দিলো। মন্টু তো বসে শুধু পাত্রীকেই দেখতে লাগলো।
চাঁদনী কেবল মিটিমিটি হাসছে মন্টুর এমন অবস্থা দেখে। সানজু বসে, বসে সবাইকেই দেখছে। কতক্ষণ আর মাথা নিচু করে বসে থাকা যায়। সানজু এক সময় শৌখিনের দিকেও তাকালো। শৌখিন আরেক দিকে তাকানো। সানজু কিছুক্ষণ শৌখিনের দিকেই তাকিয়ে রইল। কিন্তু হঠাৎ করে তাকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিলো শৌখিন। হুট করেই সেও তাকালো সানজুর দিকে। শৌখিনের সাথে চোখাচোখি হতেই সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেললো সানজু। মনে মনে নিজেকে হাজারটা গালি দিলো। কী...কী দরকার ছিল তার দিকে তাকানোর? এতক্ষণ চুপিচুপি তার দিকে তাকিয়েছিল জানতে পারলে কী ভাববে লোকটা? হায় আল্লাহ!
_____________
মন্টু পাত্রীর বাড়ি থেকে ফেরার সময় আধা পথ এসে অটো থামিয়ে নেমে পড়লো অটো থেকে। মনে মনে ক্ষুব্ধ সে। ভীষণ ক্ষুব্ধ! সাবের সাহেব অটোর ভিতর বসে রাগী গলায় চেচিয়ে ডাকলো,
"মন্টু! মন্টু..."
কিন্তু মন্টু ডাক শুনেও শুনলো না। সে হনহন করে হেঁটেই চলেছে। কোথায় যাচ্ছে সে নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই!
এবার আর বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে রাখেনি মন্টু। গাড়ির ভিতরে বসেই ঝামেলা শুরু করে দিয়েছে। পাত্রীর বাড়ি থেকে বের হয়ে সে সাবের সাহেবের সাথে বসেছিল এক অটোতে। ঝন্টুকে দিয়েছিল চাঁদনীদের সাথে। সে সময় আগের মতো হুমকি দিলো সে,
"এই মেয়ের সাথে কিছুতেই ঝন্টুর বিয়ে দিতে পারবে না তোমরা। যদি দেওয়ার চেষ্টা করো, তাহলে বাড়ি থেকে চলে যাব। দিন যাবে, মাস যাবে, বছরও ফুরিয়ে যাবে তবুও আর খুঁজে পাবে না আমায়। ফেরারি হয়ে যাব আমি। ফেরারি!"
সাবের সাহেব এত সহজে আর মেনে নিলেন না এবার। রোজ, রোজ এক ঝামেলা পোহানো যায় না। গাড়ির ভিতর এ নিয়ে কথা কাটা কাটি হলো। ঝগড়া হলো তুমুল বেগে। আর মন্টু গেল নেমে।
হেঁটেই চলেছে মন্টু থামার নাম গন্ধ নেই। সাবের সাহেব শুধু রাগে ফুঁসছেন বসে বসে। পারভেনু বিবি অটো থেকে নেমে কাঁদো কাঁদো গলায় ডাকলেন,
"আহারে, পাগলামি করে না বাপ! ফিইরা আয়, ফিইরা আয়।"
পারভেনু বিবির ডাক মন্টুর কানে গেল বলে মনে হলো না। মন্টু ইতোমধ্যে অনেকদূরে চলে গেছে। শৌখিন এমন কাণ্ড দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারলো না। অটো থেকে নেমে সে দৌঁড়ে গেল মন্টুর কাছে। মন্টুকে ধরতে একটু বেগ পেতে হলো অবশ্য। শৌখিন পিছন থেকে গিয়ে ঝাপটে ধরলো মন্টুকে। আকুতি নিয়ে বললো,
"যাবেন না, ভাই। যাবেন না।"
মন্টু শৌখিনের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
"ছাড়েন, ভূত ভায়া। আমি চলেই যাব। যেখানে আমার মতের কোনো গুরুত্ব নাই, সেখানে এক মুহূর্তও থাকবো না। ছাড়েন আমায়!"
শৌখিন ছাড়লো না।
"না আপনি যেতে পারবেন না। যেতে দেবো না আপনাকে। অটোতে ফিরে চলেন।"
সবাই অটোর কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো দূরের শৌখিন আর মন্টুকে। মন্টু আর শৌখিনের মাঝে বিবাদ হচ্ছে। ঝন্টু এমন অবস্থা দেখে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল। চাঁদনী ধমক দিয়ে বললো,
"আহ, ঝন্টু কাকা কাঁদো কী করে শরম করে না? পুরুষ মানুষ হয়েও কাঁদো!"
চাঁদনীর ধমক শুনে ঝন্টু শান্ত হয়ে যায়।
ওদিকে মন্টু আর শৌখিনের মাঝে ধস্তাধস্তি শুরু হওয়ার মতো অবস্থা। মন্টু একবার শৌখিনকে ছাড়িয়ে প্রায় চলে যেতেই নিয়েছিল। কিন্তু শৌখিন আবার ধরে ফেলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরেও আর রাখা গেল না। মন্টু গেল তো গেলই।
শৌখিন ব্যর্থ হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অটোর কাছে ফিরলো। সাবের সাহেব কড়া মুখে সবাইকে আদেশ দিলেন,
"সবাই গাড়িতে ওঠো। এক্ষুনি।"
_____________
রাত হয়েছে অনেক। আকাশ পরিষ্কার। আজ সারাদিনে বৃষ্টি হয়নি। মাটি শুকিয়ে গেছে প্রখর রোদে। বাইরে ঠাণ্ডা। বাতাস ভালোই আছে। শৌখিন একা বসে আছে কদম তলায়। মন্টু এখনও বাড়ি ফেরেনি। ঘরের ভিতর বসে পারভেনু বিবি কাঁদছেন। হেলেনা, চাঁদনী থামতে বলছে তাও থামছে না। ঝন্টু নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা নিজেরও খেয়াল নেই। সাবের সাহেব কঠিন মুখ করে দরজা আটকে বসে আছেন রুমে। আনতে যাবেন না তিনি মন্টুকে। একটা শিক্ষা হওয়া উচিত মন্টুর।
সানজু বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রবেশদ্বারের দিকে তাকিয়ে আছে। যদি দেখা যায় মন্টু কাকাকে!
মাঝে মাঝে শৌখিনকেও দেখছে। লোকটার মন যে খুব খারাপ সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
রাত আরও হলো। মন্টু এলো না। শৌখিন অস্থিরতা নিয়ে আর বসে থাকতে পারলো না। উঠে প্রবেশদ্বারের দিকে যেতে নিলেই কেউ একজন একটা হাত টেনে ধরলো তার। শৌখিন থেমে গেল। পিছনে তাকাতে দেখতে পেল, সানজুকে। সানজু কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো,
"কোথায় যাচ্ছেন?"
"ওনাকে ফিরিয়ে আনি গিয়ে।"
"পারবেন না। মন্টু কাকা কোথায় গেছে সেটা কি জানেন আপনি? তাছাড়া গ্রামও ভালো করে চেনেন না। কোথায় যেতে কোথায় চলে যাবেন কে জানে!"
শৌখিন সানজুর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
"ঠিকই ফিরিয়ে নিয়ে আসবো ওনাকে। চিন্তা করবেন না।"
শৌখিন হাসার চেষ্টা করলো।
সানজুর কোনো কথা না শুনেই বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। সানজু শুধু তাকিয়ে রইল দূরে অন্ধকারে। কে জানে একজনকে খুঁজতে গিয়ে সে নিজেই না হারিয়ে যায়! মন্টু কাকা তো বাড়ি চিনে তাও আসতে পারবে। সে কী করবে?
সানজু চিন্তায় পড়লো। কিন্তু এই চিন্তা কাজের না কি অকাজের?
_____________
রাতের আঁধার কেটে পশ্চিম আকাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখি ডেকে উঠছে। না তো মন্টু বাড়ি ফিরেছে, না তো শৌখিন।
সানজু নিজের ঘরে জানলার ধারে বসে পথের দিকে তাকিয়ে আছে। নিরাশ তার চোখের চাহনি। কোথায় গেল মন্টু কাকা? আর কোথায়ই বা গেল শৌখিন লোকটা?
সানজুর চোখ হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠলো। দু চোখে হাজারও আনন্দ খেলে গেল। সানজু ছুটে ঘর থেকে বের হলো। বাড়ির সামনে এসে উঁচু গলায় সবাইকে ডাকলো,
"কোথায় গেলে তোমরা? মন্টু কাকা আসছে। দাদি গো মন্টু কাকা আসছে।"
মন্টু কাছে আসতেই সানজু অভিমানীনি গলায় বললো,
"কোথায় গিয়েছিলে? কোথায় ছিলে সারা রাত?"
মন্টু কিছু বলার জন্য মুখ খুললেই, ঘর থেকে পারভেনু বিবি এসে মন্টুকে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। মন্টু মায়ের এমন বাচ্চামি দেখে বললো,
"আরে আম্মা, কাঁদো কেন? কান্নার প্রতিযোগিতায় নাম লিখাইছো না কি?"
পারভেনু বিবি কিছু বললেন না। শুধু কাঁদতে লাগলেন। চাঁদনী, হেলেনা প্রশ্নের ভাণ্ডার খুলে বসলো মন্টুর কাছে।
সানজু অবিশ্বাস্য ভাবে তাকিয়ে আছে শৌখিনের দিকে। কী করে খুঁজে পেল উনি মন্টু কাকাকে? সানজু জানে, মন্টু কাকাকে বাড়িতে নিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা না। যেভাবে চলে গিয়েছিল তাতে দশ দিনের আগে কিছুতেই আসতো না। আগের ঘটনা থেকেই উপলব্ধি করা যায় সেটা। তাহলে উনি কী করে...
শৌখিন ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো সানজুর দিকে। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়ালো। নিচু স্বরে বললো,
"বলেছিলাম না, ওনাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। আমি আমার কথা রেখেছি।"
শৌখিন হেসে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
শৌখিনের কথাটা বেশ মনে ধরলো সানজুর। কী ছিল ওই কথার মাঝে? সানজু নিজের অজান্তেই হাসলো। তারপর পিছন ফিরে শৌখিনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
"কে আপনি?"
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ১৫ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
বৃষ্টি পড়ার টুপ টুপ শব্দ হচ্ছে। রাতের অন্ধকারে বৃষ্টি হওয়া মানে যেন, কারো বিষাদ হৃদয় থেকে রক্ত ক্ষরণের মতো। যেন হাজার কষ্টের সাক্ষী হয়েই এই বৃষ্টির আকাশ থেকে ঝরে পড়া। আর সেই বৃষ্টির মাঝেই কেউ একজন নিজের কষ্ট উপলব্ধিতে দাঁড়িয়ে আছে শূন্য মনে। যে অনুভব করতে পারছে না বৃষ্টির শীতলতা। দাঁড়িয়ে আছে ঠিক একটা পাথরের ন্যায়। সানজু অনেকক্ষণ ধরেই দেখে যাচ্ছে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে। লোকটা রাতের বেলা কেন ভিজছে বৃষ্টিতে?
বাড়ির সবাই মনে হয় ইতোমধ্যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কী ভাবছে লোকটা? সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে বলে, কেউ তার এই পাগলের মতো বৃষ্টিতে ভেজা দেখতে পাবে না? কিন্তু, সানজু তো ঠিকই দেখছে! লোকটার সমস্যা কী?
এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে এসব দেখতে সানজুর ভালো লাগছে না। সানজু রুম থেকে নিজের নীল রঙের ছাতাটা নিয়ে বের হলো। সদর দরজা ভেজানো ছিল। সেটা খুলতেই কেমন ভোঁতা শব্দ হলো। সানজু সচকিত হয়ে আশপাশে তাকালো। নীরবে দরজার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলো বাড়ির লোকজন কেউ জেগে উঠেছে কি না। না কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সানজু খুব সাবধানে পা ফেলে ঘর থেকে বের হলো।
সানজুর আবার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো লোকটার মাথায় সমস্যা আছে। দরজা কীভাবে এমন করে খুলে রাখতে পারে? যদি এদিক দিয়ে কেউ এসে ঘরে ঢুকে কিছু নিয়ে যায় তখন? লোকটার কি সে বিষয়ে কিছু যায় আসে না? না কি এ ঘরে তার কোনো জিনিসপত্র নেই বলে সে পরোয়া করে না? সানজুর মনে হলো লোকটা বেইমান! হোক তার কিছু নেই এই ঘরে, লোকে নিয়ে গেলেও কিছু যায় আসে না তার। কিন্তু, যে ঘরে এতদিন থাকলো, খেলো সে ঘরে এত বড়ো সর্বনাশ হবে তা ভেবেও কি তার খারাপ লাগে না? সানজু আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে শৌখিনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। শৌখিন কদম গাছের সামনে দাঁড়ানো। বারান্দার লাইটের আলোয় সানজু পিছন থেকে দেখতে পেল লোকটা ভিজে একাকার। সানজু ছাতা দিয়ে শৌখিনের মাথার উপর থেকে বৃষ্টি আড়াল করলো। শৌখিন ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল। পাশে তাকাতেই সানজু বললো,
"ভিজেন কেন বৃষ্টিতে? শীত লাগে না? পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকেন, পা ব্যথা করে না?"
"না, করে না।" শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলো শৌখিন।
সানজু একবার শৌখিনের পায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
"আপনার কি রোবটের পা, যে ব্যথা করে না?"
"রোবট নিয়ে আমাদের আরও একদিন কথা হয়েছে।"
"তো? একটা বিষয় নিয়ে যে একবারই কথা বলা যাবে, আর কোনো দিনও বলা যাবে না এমন কোনো নিয়ম আছে?"
"জানি না।"
সানজু সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললো না। খানিক চুপ থেকে বললো,
"কবে বলবেন আমায়?"
"কী?"
"আপনার পরিচয়?"
"কয়েকদিন ধরে তো চুপ ছিলেন, তাহলে আজ আবার কেন শুরু করলেন?"
"চুপ ছিলাম কারণ, দেখতে চেয়েছিলাম আপনি স্ব-ইচ্ছায় বলেন কি না। কিন্তু, আপনি বলেননি। তাই আমাকেই আবার জিজ্ঞেস করতে হলো। বলবেন না আমায়? সেদিন তো বলেছিলেন, বলবেন। তাহলে বলছেন না কেন?"
"নিশ্চয়ই বলবো আপনাকে।" আশ্বাস দিয়ে বললো শৌখিন।
"কবে?"
"আষাঢ় শেষ হওয়ার আগে।"
"আবার আষাঢ়! কী আছে এই আষাঢ়ে? আষাঢ় তো সাধারণ একটা মাস। বৃষ্টির মাস। তাহলে এত আষাঢ়, আষাঢ় কেন করেন?"
"সেটাও বলবো আপনাকে। খুশি হবেন তখন?"
সানজু কিছু বলতে গিয়েও বললো না। একটু দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বললো,
"আরও ভিজবেন বৃষ্টিতে? না কি ঘরে যাবেন?"
"ভিজি আরও একটু। ভিজতে কিন্তু খারাপ লাগে না। আপনি ভিজবেন?"
শৌখিনের হঠাৎ এমন প্রশ্নে সানজু একটু হকচকিয়ে গেল। কিন্তু দ্রুত উত্তর দিলো,
"জি না। ভিজবো না আমি। আমার আপনার মতো মাথা খারাপ না।"
"আমার মাথা খারাপ?" সহজ ভাবে জানতে চাইলো শৌখিন।
"জি। মেন্টালিটি সমস্যা আছে আপনার।"
সানজু শৌখিনের মাথা থেকে ছাতা সরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে থামলো আবার। পিছন ফিরে বললো,
"দ্রুত ঘরে গিয়ে কাপড় পাল্টান। নয়তো জ্বর আসবে!"
সানজু ভালো করেই জানে, শৌখিনের ওসব জ্বর টর কিছু আসবে না। আসার হলে আগেই আসতো। তারপরও জ্বরের কথাটা কেন বললো? দরদ দেখাতে চাইলো কি কোনো ভাবে? না কি মানুষটার জন্য ওর একটু বেশিই চিন্তা?
_______________
হলরুমের পুরোনো দিনের দেয়াল ঘড়িটা বিকট শব্দ করে জানান দিলো, সকাল দশটা বেজে গেছে। হলরুমে চারজন ব্যক্তি উপস্থিত। মন্টু, ঝন্টু, সাব্বির এবং সানজু। সানজু, সাব্বির এক সাথে বসে মোবাইলে গেমস খেলছে। উল্লাস করছে। মন্টু বসা ছিল ওদের বিপরীত সোফায়। পিঠা খাচ্ছিল। সাব্বিরদের এমন উল্লাস দেখে আর স্থির থাকতে পারলো না। সে ধপ করে গিয়ে বসলো সাব্বিরের পাশে। একেবারে গা ঘেঁষে বসলো। মোবাইলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
"দে, মোবাইলটা এদিক দে।"
সাব্বির মোবাইল দূরে সরিয়ে ফেললো মন্টুর থেকে। বললো,
"তোমার কি আর গেমস খেলার বয়স আছে?"
"না আমার নাই, তোদের আছে! আমার থাকবে কী করে? আমি তো একশ বছরের বুড়া থুনথুনে। কিছুই ধরতে পারি না। আর তোরা তো হলি তরুণ সমাজ। গায়ে সুপার ম্যানের শক্তি। আস্ত একটা বিল্ডিংও উঠিয়ে আছাড় মারতে পারবি।"
মন্টুর কথা গায়ে লাগলো সাব্বিরের।
"মন্টু কাকা, তুমি কিন্তু..."
"শোকেন, ও শোকেন। কই গেলা তুমি?" কেউ একজন ডাকতে, ডাকতে এগিয়ে আসছে হলরুমের দিকে।
এমন আজব ডাক শুনে সাব্বির নিজের কথা শেষ করতে পারলো না, থেমে গেল মাঝ পথে। মন্টুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
"শোকেন কী জিনিস গো মন্টু কাকা?"
মন্টু কিছু উত্তর দেওয়ার আগে 'শোকেন, শোকেন' করতে করতে উপস্থিত হলো পারভেনু বিবি। সাব্বির পারভেনু বিবিকেই জিজ্ঞেস করলো,
"কীসের কথা বলো দাদি?"
"আরে, শোকেন। শোকেনের কথা কই।"
সানজু ভাবতে ভাবতে বললো,
"শোকেন! শোকেন মানে কী?...দাদি তুমি কি শোকেস এর কথা বলছো?"
"আরে না, আমি তো ওই পোলার কথা কই। রুমে গিয়া খুঁইজা আইলাম, দেহি পোলাডা নাই!"
সাব্বির কিছুটা আঁচ করতে পেরে বললো,
"শৌখিন ভাইয়ের কথা বলছো?"
"হ, হ হের কথাই কই। কই গেল পোলাডা?"
সানজুর কেন জানি গায় লাগলো খুব। পারভেনু বিবির মুখে শৌখিনের নামটা এমন ভাবে শুনতে একেবারেই ভালো লাগলো না তার। সে তেজি গলায় বললো,
"ওনাকে তুমি শোকেন বলছো কেন? ওনার নাম কি শোকেন? শৌখিন...শৌখিন ওনার নাম।"
"ওই একই তো, শোখেন! তা কই গেছে পোলাডা? তুই দেখছো, সাজু? ওই সাবু তুই দেখছো? মন্টু, ঝন্টু তোরা দেখছোস?"
এখানে পারভেনু বিবি মূলত সানজুকে 'সাজু', আর সাব্বিরকে 'সাবু' বলেছে।
এবার সাব্বিরের মেজাজ বিগড়ে গেল।
"তোমার সমস্যা কী দাদি?
"কী? কী সমস্যা আমার?"
"সাবু কী? হাহ? সাবু কী? ইচ্ছা করে তুমি আমাদের নাম আবোল তাবোল ডাকো। আমাদের নাম ধরে ডাকতে তোমার এলার্জি। আর ওদিকে নিজের ছেলেদের নাম তো একেবারে সঠিক বানান, উচ্চারণে ডাকো!"
"তোগেরে নাম কঠিন। সাব্বুর, সাজ্জু। কইতে কইতেই ভাত খাওনের খিদা লাইগা যায়।"
"ভাত খাওনের কেন? একটা সমুদ্রের পানি খাওনের ক্ষিদে লাগে সেটা বলো!"
মন্টু সাব্বিরকে ধমক দিয়ে বললো,
"আহ্ সাব্বির, চুপ কর।"
তারপর মায়ের দিকে কোমল চোখে তাকিয়ে বললো,
"আম্মা, ভূত ভাই তো ভাইজানের সাথে ক্ষেতে গেছে।"
"ও! পোলাডার লগে একটু কথা আছিল। দেখা সাক্ষাৎই পাওন যায় না পোলাডার!"
পারভেনু বিবি নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন।
সাব্বির মন্টুর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
"আহ্ মা ছেলের ভালুবাসার শেষ নাই।"
মন্টু কটমট করে বললো,
"ওই সাব্বির, কী বললি?"
"আমার মাথা!" জোরে উত্তর দিলো সাব্বির।
______________
চাঁদনী হাতে আচারের তিন তিনটা বয়াম নিয়ে শৌখিনের ঘরের দিকে যাচ্ছে। রুমের দরজা দেওয়া। হাত আটকা থাকায় পা দিয়ে আস্তে আঘাত করলো দরজায়।
ভিতর থেকে ভেসে এলো,
"দরজা খোলাই। জোরে আঘাত করে ভিতরে ঢুকে পড়ুন।"
চাঁদনী তাই করলো পা দিয়ে একটু জোরে ঠেলা দিলো। দরজা খুলে গেল। চাঁদনী আচারের বয়াম নিয়ে রুমে ঢুকলো। টেবিলের উপর রাখলো তিনটা বয়াম। শৌখিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
"এগুলো কী?"
চাঁদনী বিস্ময় নিয়ে বললো,
"একি! এরই মধ্যে ভুলে গেছেন? আচার কী তা তো জানালাম আপনাকে।"
"ও...এগুলো আচার?"
"হুম, আচার।"
চাঁদনী বয়াম তিনটা নিয়ে মেঝেতে পাতা বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। তিনটা বয়াম মেঝেতে রেখে নিজেও বসলো। শৌখিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
"ওই যে আমরা আম কুড়িয়ে ছিলাম, মনে আছে?"
শৌখিন মাথা নেড়ে বললো,
"হুম।"
"এখানের আচার গুলো সেই আম দিয়েই তৈরি। আপনাকে আগেই দেখানো উচিত ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা হলো, ভুলে গিয়েছিলাম।"
চাঁদনী বয়াম তিনটার দিকে আঙ্গুল নির্দেশক করে বললো,
"তিনটা বয়ামে কিন্তু তিন ধরনের আচার। টক ঝাল মিষ্টি মিক্স, ঝাল, মিষ্টি, সব আচারই আছে।"
চাঁদনী একটা বয়ামের মুখ খুললো। দুই আঙ্গুল দিয়ে তেলের ভিতর থেকে উঠিয়ে আনলো এক পিস আম। তারপর তা এগিয়ে দিলো শৌখিনের দিকে। খেতে বললো। শৌখিন খেয়ে বললো,
"ভালো। তবে একটু বেশি ঝাল।"
চাঁদনী হাসলো। তারপর বয়ামের মুখ আটকালো। বললো,
"এগুলো এখানে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হলো শুধু আপনাকে দেখানো। আপনার জন্য আমি আলাদা বয়ামে দিয়ে যাব। দেখবেন, এগুলো পরের বছরও ভালো থাকবে।"
শৌখিনের মুখ গম্ভীর হলো। কোথাও একটা খারাপ অনুভূতি হচ্ছে। শৌখিন অন্যমনস্ক ভাবে বললো,
"হয়তো দেখার সুযোগ আর মিলবে না।"
চাঁদনী স্পষ্ট শুনতে পেল না।
"হ্যাঁ, কী বলছেন?"
শৌখিন কিছু বললো না। উঠে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
চাঁদনী অবিশ্বাস্য ভাবে তাকিয়ে রইল দরজার দিকে। লোকটা কত বড়ো বেয়াদব! একটা মানুষ তার কাছে আসলো কথা বলতে, অথচ সে কোনো কথা না বলে, এক প্রকার উপেক্ষা করে চলে গেল! চরম বেয়াদব! চাঁদনীর খুব রাগ হলো। সাথে মন খারাপও হলো!
শৌখিন হাঁটতে হাঁটতে কদম তলার নিচে এলো। বেঞ্চিতে বসলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
"ক্ষমতা থাকলে এখানেই সময় থামিয়ে দিতাম।"
শৌখিন ধীরে ধীরে চোখ তুলে সানজুর রুমের জানালার দিকে তাকালো।
সানজু জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে শৌখিনের দিকেই তাকিয়ে আছে। শৌখিন তাকানোতেও সানজু চোখ ফিরিয়ে নিলো না। বরং আরও গভীর দৃষ্টি মেলে তাকালো। কেন জানি চোখের পলক ফেলতেও ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে শুধুই তাকিয়ে থাকতে।
সানজুর মনে হঠাৎই কেমন খারাপ শঙ্কা উদয় হলো। কেন জানি মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঠিক হবে না। হার্টটা একটু জোরেই কেঁপে উঠলো সানজুর।
____________
"নৌকায় ঘুরতে যাইবো?"
ঝন্টু মাথা নাড়িয়ে বললো,
"জি আম্মা।"
"আইচ্ছা তুই যা অহন।"
ঝন্টু বেরিয়ে গেল।
পারভেনু বিবি মনে মনে বললেন,
"দেখছোস নি কারবার! ওরা নৌকায় কইরা ঘুরতে যাইবো আর আমারে কয় নাই।"
পারভেনু বিবি দ্রুত আলমারির দিকে এগিয়ে গেলেন।
একজন একজন করে সবাই উপস্থিত হলো হলরুমে। ঘুরতে যাবে মোট পাঁচ জন। মন্টু, সাব্বির, সানজু, চাঁদনী ও শৌখিন। ঝন্টু যাবে না। নৌকায় চড়তে তার ভয় হয়। নৌকা একটু হেলেদুলে উঠলেই মনে হয় তার জান যায় যায়।
বাড়ি থেকে একটু দূরেই খাল। বিশাল বড়ো খাল। সেখানে নৌকাও পাওয়া যায়। তাতে করেই ঘোরা হবে। মন্টু জিন্স গুটিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
"আচ্ছা শোন, নৌকা কিন্তু আমি চালাবো।"
সাব্বির বাধা দিয়ে বললো,
"থাক, তোমার চালাতে হবে না। তুমি যে কী নৌকা চালাবা তা বোঝা হয়ে গেছে। দেখা যাবে নৌকা সহ আমাদের সবাইকে ডুবিয়ে মারবে! নৌকা ফরিদ ভাই-ই চালাবে।"
ফরিদ হলো যার নৌকা সে।
মন্টু সাব্বিরের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো,
"বেশি বুঝিস তাই না? ছোট বেলায় কত নৌকা চালাইছি তোর কোনো ধারণা আছে?"
"আছে। একবার যে ঝন্টু কাকাকে নিয়ে মরতে বসেছিলে, সেটা কি কারো অজানা?"
"কে বলছে তোরে এই কথা?"
"দাদি বলছে, দাদি। তোমার আম্মা।"
মন্টু মনে মনে বললো,
"ইশ! এই আম্মার পেটে কোনো কথা পচে না।"
মুখে বললো,
"এসব ফাও কথা রেখে হাঁটা লাগা।"
"আমারে রাইখা কই যাও তোরা?" পারভেনু বিবি উপস্থিত হলো হলরুমে।
পারভেনু বিবি একটা কাতান শাড়ি পড়েছেন। কাপড়টা নতুন কেনা। ঘুরতে গেলে তো আর পুরোনো কাপড় পরে যাওয়া যায় না!
চাঁদনী বললো,
"কী ব্যাপার দাদি! সেজেগুজে কই যাও?"
"আরে আমি তো তোগো লগে যাওনের লাইগা আইলাম।"
"কী? আমাদের সাথে যাবে?" চাঁদনী বিস্ময়ে বিমোহিত।
"হ, যামু। এতে এত অবাক হওনের কী হইলো? আর হুন, আমি কিন্তু নৌকায় শোকেনের পাশে বসুম। আমারে কিন্তু শোকেনের লগে দিতে হইবো।"
পারভেনু বিবির কথা শুনে সানজুর কেন যেন খুব রাগ হলো। বললো,
"দেখো দাদি, বুড়া বয়সে ভীমরতিতে ধরার মতো করবা না।"
পারভেনু বিবি সানজুকে মন্টুর সাথে তুলনা করে বললেন,
"তুই হইছো এক্কেরে তোর ছোট চাচার লাহান ক্যাটকেইট্টা!"
মন্টু এসব শুনেও নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে অতি নরম কণ্ঠে বললো,
"আম্মা, ঠান্ডা মাথায় শোনো, ওই ছোট নৌকায় এত মানুষ ধরবে না। তোমার বসার মতো কোনো জায়গা থাকবে না।"
পারভেনু বিবি কাঠ কাঠ গলায় বললেন,
"তাইলে সাবুরে আর সাজুরে থুইয়্যা যা। আমি যামুই।"
পারভেনু বিবির কথা শুনে সবাই চমকে উঠলো। সানজু দাদির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে, দাদির মতোই কাঠ কাঠ গলায় বললো,
"অসম্ভব! আমি তো যাবই। তোমার ভীমরতির জন্য তো আর আমার যাওয়া বরবাদ করতে পারি না।"
সাব্বিরও সানজুর সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
"আমিও যাব। দুনিয়া ভেসে গেলেও আমি ঘরে থাকবো না।"
শৌখিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার কান্ড দেখছে।
মন্টু পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য, মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো,
"আম্মা গো, তুমি যেটা বুঝতেছ ব্যাপারটা তা না। শৌখিন ভাই মোটেও আব্বার মতো দেখতে না। ওটা তোমার মনের ভুল।"
পারভেনু বিবি তাকালো মন্টুর দিকে। গলা চড়াও করে বললো,
"তোরে কেউ কইতে কইছে? কেউ জিগাইছে তোর কাছে? ঘোরতে যাওনের লগে এই কথা উঠছে কই থেইকা?"
"কেন উঠবে না? তুমি তো সেটাই মনে করে বসে আছো। গেল বছর সবাই মিলে ঘুরতে গেলাম নদীর চড়ে। কিন্তু তুমি গেলে না। তোমায় কিছুতেই নেওয়া গেল না। তোমার পায়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা! আরও কত বাহানা দিলে। আর আজ দৌঁড়ে চলে আসছো ঘুরতে যাওয়ার জন্য।"
পারভেনু বিবি গলা আগের থেকে আরও চড়াও করে বললো,
"তুই চোপ! তোরে ঢাকা শহরে পড়াইছি কি এমন বেয়াদবি করার লাইগা? আমার ঝন্টু বাপরে দ্যাখ, ঢাকায় পইড়া লেইখ্যা কত ভালো ভদ্র মানুষ হইছে। আর তোর দিকে চাইয়া দ্যাখ, তুই কী হইছো! তুই হইছো বান্দরের থেইকাও অধম! না, তোরে আর বাড়িতে রাহা যাইব না। সাবেরের লগে কথা কইয়া তোরে বিদাশ পাডানোর ব্যবস্থা করতাছি। বিদাশ গিয়া কাজ কাম কইরা খাইলে তোর বাঁদরামি ছুইটা যাইব। এই ফাঁকে ঝন্টুরেও বিয়া দেওন যাইব।"
পারভেনু বিবির কথা শেষ হতে না হতেই মন্টু হন হন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সবার বুঝতে বাকি নেই মন্টু রাগ করেছে। কিন্তু মন্টু রাগ করলে তাদের ঘুরতে যাওয়ার কী হবে? চাঁদনী পারভেনু বিবির প্রতি রাগ দেখিয়ে বললো,
"দাদি, এটা তুমি কী করলা? আমাদের ঘুরতে যাওয়াটা পন্ড না করলেই কি হতো না তোমার? মন্টু কাকার রাগ না পড়লে ঘুরতে যাব কী করে আমরা? ধ্যাত! সব জায়গায় কেলেঙ্কারি লাগাও তুমি! কী দরকার ছিল মন্টু কাকাকে এইসব আজাইরা কথা বলার?"
পারভেনু বিবি কিছু বললেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন মুখ শক্ত করে।
সবাই হলরুমেই দাঁড়িয়ে রইল নিরাশ মুখে। এখন কে যাবে মন্টুকে বোঝাতে? বোঝাতে গেলেই কি আর বুঝবে? যেই রাগ তার!
কিন্তু মন্টু সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিজেই উপস্থিত হলো কিছুক্ষণ পর। তাও আবার হাসতে হাসতে। এসে বললো,
"কী খবর জনগণ, এখানে এরকম মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী? লেটস কাম অন এনজয়।"
কেউ আর কথা প্যাঁচালো না। বিনা বাক্যে ঘর থেকে বের হলো। মন্টু সবার পিছনে। যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
"বুঝলি তোরা, কেউ একজন হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।
মন্টুর কথা শুনে বাকিরাও হেসে উঠলো।
পারভেনু বিবি বিড়বিড় করে বললেন,
"কী বজ্জাত পোলা! পোলাডার সাহস দিন দিন আসমান ছুইতাছে। সাথে নাতি নাতনি কয়ডাও
হইছে বজ্জাত। হইব না, এক রক্ত না।"
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ১৬ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
সাবের সাহেবের ঘরে আলোচলা সভা বসেছে। মন্টু, ঝন্টু আর শৌখিন ছাড়া বাকিরা সবাই উপস্থিত আছে। মন্টু, ঝন্টু রোজকার মতো আযান হওয়ার সাথে সাথে ঘর থেকে বের হয়েছে। সাথে শৌখিনকেও নিয়ে গেছে। মসজিদে নামাজ পড়ে খানিক আড্ডা মেরে তবেই বাড়িতে আসবে। এরই ফাঁকে এই আলোচনা সভা শেষ হবে।
সাবের সাহেবের রুমে আলোচনার বিষয় হলো পাত্রী দেখতে যাওয়া নিয়ে। সেদিন মন্টু রাগ করে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর সাবের সাহেব খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি সেদিন গভীর ভাবে ভেবেছেন সারা রাত ধরে। ঝন্টুর বিয়ে নিয়ে বার বার যে সমস্যা হয়, তা চলতে থাকলে ঝন্টু, মন্টু কারোরই হয়তো বিয়ে হবে না এই জীবনে। তাই তিনি চারদিকে লোক লাগিয়ে দিয়েছিল বিয়ের উপযুক্ত কোনো যমজ মেয়ে পাওয়া যায় কি না সেই খোঁজে। অনেক খুঁজেও বিয়ের উপযুক্ত যমজ মেয়ে পাওয়া যায়নি, তবে এক ঘরে দুইটা মেয়ে পাওয়া গেছে সমবয়সী। মেয়ে দুটি একে অপরের চাচাতো বোন। যৌথ ফ্যামিলি তাদের। দুজনে দেখতে প্রায় একই রকম।
এবার আর ঝন্টুর একার জন্য পাত্রী দেখতে যাওয়া হবে না। মন্টুর জন্যও দেখা হবে। মন্টু এইবার দুইজন পাত্রী থেকে যে কোনো একজনকে পছন্দ করুক, কোনো সমস্যা হবে না। পাত্রী নিয়ে টানাটানি কিছুতেই হবে না এবার।
কিন্তু এবার মন্টুকে সাথে করে নিয়ে পাত্রী দেখতে যাবে না। বলা তো যায় না, সব কিছু ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও কোথা থেকে কোন প্যাঁচ লাগায় মন্টু। এবার আর কোনো প্রকার ঝামেলা চান না সাবের সাহেব। মেয়ে দেখে পছন্দ হলে, বিয়ে ঠিক করে এসে তবেই জানানো হবে মন্টুকে। সাবের সাহেবরা কাল সকালেই পাত্রী দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। পাত্রীর বাড়ি অনেক দূরে।
এবার আর মন্টুকে জানানোও হবে না যে তারা পাত্রী দেখতে যাচ্ছে। মন্টুর কাছ থেকে এই ব্যাপারে সব কিছুই গোপন রাখা হবে। মন্টুকে কাল সারা দিন দোকানে বসিয়ে রাখবেন সাবের সাহেব। সাবের সাহেবদের তিনটা দোকান আছে বাজারে। দুইটা ভাড়া দেওয়া। একটা নিজেদের। সেখানে দু জন লোক রাখা আছে। সেই দুজনকে কাল দোকানে আসতে নিষেধ করে দিয়েছেন তিনি। তাদের জায়গায়ই মন্টুকে বসিয়ে দেবে কালকে।
সাব্বিরের এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে। এক সাথে দুই পাত্রী দেখতে যাওয়ার ব্যাপারটা কেমন হবে? নিশ্চয়ই খুব মজার! সাব্বিরের ইচ্ছা হলো এবার সেও পাত্রী দেখতে যাওয়ায় যোগ দেয়। মনে মনে ঠিক করলো সেও যাবে। ব্যাপারটা আর শুধু নিজের মাঝেই রাখলো না, উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেই ফেললো,
"ব্যাপারটা খুব মজার মনে হচ্ছে! এবার আমিও যাব পাত্রী দেখতে।"
কিন্তু হেলেনা সাব্বিরের উচ্ছ্বাসে পানি ঢেলে বললো,
"না আপনার এ মজার দৃশ্য দেখা হবে না। বাড়িতেই থাকতে হবে আপনার।"
"কেন? কেন? বাড়িতে থাকতে হবে কেন?"
"বাড়িতে থেকে সানজুর দেখা শোনা করবি।"
আজকে বিকালে ছাদ থেকে চাঁদনীর সাথে বক বক করতে করতে নামার সময়, বেখেয়ালে সিঁড়ির এক ধাপ রেখে পরের ধাপে পা রাখতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে যায় সানজু। পা'য়ে আঘাত পায় তখন। ঠিকঠাক ভাবে হাঁটতে পারে না এখন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়। তাও একটু হাঁটলেই ব্যথা অনুভব হয়।
সাব্বির গর্জে বলে উঠলো,
"কেন? কেন? সানজুর দেখা শোনা করতে হবে কেন? ও কি ছোট বাচ্চা? এত দিন তোমরা পাত্রী দেখতে গেলেও, কোনো দিন আমি যেতে চাইনি। আমায় ডাকাডাকি করলেও যাইনি। আজকে নিজে থেকে একটু যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলাম। আর অমনি তোমরা..."
"যে জীবনে যায় নাই, তার একদিন না গেলে কী হবে? এত দিন যাসনি তাতে কী হইছে? কিছু হইছে? ঘরে থেকে কোন সময় কী লাগে মেয়েটার সেসব দেখবি। ব্যথা পায়ে কি ও হাঁটাহাঁটি করে বেড়াবে?"
"কোন সময় কী লাগবে তা আমার দেখতে হবে কেন? মন্টু কাকা তো বাড়িতেই থাকবে, সে দেখলেই তো হবে।"
"মন্টু যদি বাড়িতেই থাকতো তাহলে কি আর তোকে থাকতে বলতাম? মন্টুর মতো যত্ন কি আর তুই নিতে পারবি? মন্টু তো থাকবে দোকানে। আর এই বৃষ্টি বাদলের দিনে একা একটা মেয়েকে ঘরে রেখে সবাই কীভাবে অত দূরে যাই? বুঝিস না কিছু?"
সাব্বির সানজুর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো,
"পায়ে ব্যথা পাওয়ার আর সময় পেলি না!"
সানজু ভেংচি কেটে বললো,
"আমাকে এমন ভাবে বলছিস কেন? আমি কি ইচ্ছা করে পায়ে ব্যথা পেয়েছি?"
সাব্বির আর কিছু বললো না। মুখ গোমড়া করে বসে রইল।
সাবের সাহেব সবাইকে আর একবার হুঁশিয়ার করে বললেন,
"ঘুণাক্ষরেও যেন মন্টু কিছু না জানতে পারে। কেউ এ বিষয়ে মনের ভুলেও মুখ খুলবে না আজ।"
_______________
রাতের খাবার সময় সাবের সাহেব মন্টুর দোকানে বসার কথা উঠালেন। সব শুনে মন্টু অবাক হয়ে বললো,
"হ্যাঁ? কে বসবে দোকানে?"
সাবের সাহেব সহজ গলায় বললেন,
"তুই বসবি।"
"আমি কেন? দোকানে তো তুমি থাকো। যদি দোকানের লোক না আসে তবে তুমি বসো গিয়ে।"
সাবের সাহেব মিথ্যা বললেন,
"আমি পারব না। ক্ষেতে কাজ আছে আমার। নতুন বীজ লাগাতে হবে। কালকে তুই-ই গিয়ে বসবি দোকানে।"
মন্টু রাজি হলো না।
"আমি পারব না। ঝন্টুকে বসিয়ে দাও। ঝন্টু থাকতে শুধু শুধু আমাকে কেন বলছো?"
সাবের সাহেব মন্টুকে খুশি করার জন্য বললেন,
"আরে ঝন্টু কি একজন মানুষ হলো? ও কি আর দোকান সামলাতে পারবে?"
মন্টু মনে মনে গর্ব বোধ করলো। ঝন্টুর থেকে সব সময় বড়ো থাকতে পছন্দ করে সে। মন্টু নিজের হাসি চেপে বললো,
"সে তো আমি জানিই। ঝন্টুর দ্বারা কোনো কাজ সম্ভব নয়। ঠিক আছে আমিই বসবো দোকানে। কিন্তু একটা শর্ত আছে।"
সাবের সাহেব একটু ঘাবড়ালেন। কী শর্ত দেবে মন্টু? ঝন্টুকে নিজের সাথে দোকানে চেয়ে বসবে না তো?
সাবের সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
"কী শর্ত?"
"আমি একা বসবো না। আমার সাথে আরও এক জনকে দিতে হবে।"
সাবের সাহেব যে ভয় করেছিলেন সেটাই হলো।
"কাকে দিতে হবে?"
"আমার সাথে ভূত ভাইকে দিতে হবে।"
সাবের সাহেব মনে প্রশান্তি অনুভব করলেন। যাক কোনো কেলেঙ্কারির কথা বলেনি মন্টু। সাবের সাহেব বিনা বাক্যে সম্মতি দিলেন,
"ঠিক আছে, নিয়ে যাস শৌখিনকে।"
শৌখিন, মন্টু একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো একটু। পাশাপাশি বসা তারা। সব সময়ই পাশাপাশি বসে দুজনে। এখানে আসার পর শৌখিন যার সাথে বেশি সময় কাটিয়েছে সে হলো, মন্টু। বলতে গেলে প্রায় সারাদিনই তার সাথে থাকে। শৌখিনের ইচ্ছে হয় না যে, কখনও এই লোকটার থেকে দূরে সরে যাক সে। শুধু এই লোকটা না, সে চায় এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের সাথে জীবনের বাকি দিন গুলো কাটাতে। কিন্তু...ভাগ্য কি তার সহায় হবে?
না হবেনা! তার ভাগ্য বরাবর এমনই। যে ভাগ্য তার এক সময় প্রিয় ছিল, সেই ভাগ্যই এখানে আসার পর থেকে তার অপ্রিয় হয়ে গিয়েছে! এখন এই ভাগ্য চরম অপ্রিয় তার!
শৌখিন সামনের সারিতে বসা দূরে সানজুর দিকে তাকালো। না, এ ভাগ্য সত্যিই এখন অসহ্যনীয় তার কাছে।
______________
আকাশ কালো রূপ ধারণ করেছে। কিছুক্ষণ আগেও মোটামুটি ভালোই রোদ ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই এমন!
মন্টু দোকানে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে বের হলো। যাওয়ার পথে সানজুর ঘরে ঢুকলো। সাথে শৌখিনও ছিল, সেও প্রবেশ করলো। সানজু বিছানায় হেলান দিয়ে ইংরেজি শেখার সহজ উপায় নিয়ে লেখা একটা বই পড়ছিল। বইটা সাব্বির দিয়েছে। দিয়ে বলেছে,
'ইংরেজি শিক্ষার অনেক দরকার। বিশ্বের যে প্রান্তেই যাস না কেন ইংরেজি ভাষাটা দিয়ে ভালোই উপকার পাবি। পায়ে ব্যথা পেয়েছিস, থাকবি তো সারাদিন শুয়ে বসে। এই ফাঁকে একটু এটাও পড়। উপকার পাবি।'
সানজুও একটু খুঁটিয়ে নাটিয়ে দেখছে, ঠিক কতটুকু ইংলিশে পারদর্শী। হ্যাঁ, টুকটাক সবই পারে।
মন্টু বিছানার উপর বসে বললো,
"পায়ে ব্যথা কি কমছে রে, সানজু?"
"হুম একটু কমছে।"
মন্টুর মুখটা করুণ দেখালো। সে ব্যথিত কণ্ঠে বললো,
"চিন্তা করিস না, ঔষধ খেলে আর মলমটা মালিশ করলে ঠিক হয়ে যাবে।"
"হ বুঝছি।"
"কী খাবি তুই? বাজার থেকে কী নিয়ে আসবো তোর জন্য?"
"তোমার যা ভালো মনে হয় সেটাই নিয়ে এসো।"
মন্টু একটু হেসে বললো,
"আচ্ছা ঠিক আছে। এই অবস্থা নিয়ে আবার দৌঁড়াদৌঁড়ি করিস না।"
"দৌঁড়ানোর মতো অবস্থায় তো নেই মন্টু কাকা! আর তুমি পুরো বাজার তুলে নিয়ে এসো না যেন আবার! তোমার যা স্বভাব। দেখা যাবে পুরো ঘর ভরে ফেলেছো এনে।"
মন্টু হাসলো সানজুর কথা শুনে। বললো,
"যাচ্ছি আমরা। তাড়াতাড়ি না গেলে তোর বাপ আবার চিল্লাচিল্লি করে বাড়ি মাথায় তুলবে।"
মন্টু উঠে গেল। শৌখিন মন্টুর পিছন পিছন ঘর থেকে চলে যাওয়া দিলেই সানজু বললো,
"কেমন মানুষ আপনি?"
শৌখিন দাঁড়িয়ে গেল।
সানজু বলতে লাগলো,
"আমি পায়ে ব্যথা পেলাম, ঠিকঠাক ভাবে হাঁটতে পারছি না। অথচ আপনি...আপনি কিছুই জিজ্ঞেস করেননি আমায়! একটা বারও একটু জানতে চাইলেন না কিছু।"
শৌখিন সানজুর দিকে তাকিয়ে বললো,
"দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে আপনার পা।"
কথাটা বলে শৌখিন আর দাঁড়ালো না। বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
সানজু শূন্য দরজার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
"পাষাণ লোক একটা!"
সানজুর মনে অভিমান জমলো। কেন জমলো তা জানা নেই।
মন্টু, শৌখিন বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সাবের সাহেবেরাও বেরিয়ে পড়লেন। বাড়িতে রইল শুধু সাব্বির আর সানজু।
সাব্বির কিছু সময় পরপর সানজুর রুমে এসে জিজ্ঞেস করে যায়,
"কী লাগবে তোর? পায়ে ব্যথা কমছে?"
"খাবি কিছু? এনে দেবো?"
সানজু উত্তর দেয়,
"কিছু লাগবে না আমার।"
"খাবো না কিছু।"
সাব্বির এবার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো সানজুর রুমে। বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে।
"কী ব্যাপার ভাইয়া? কোনো সমস্যা হইছে?"
"আমার বন্ধু ফোন দিয়েছিল। কার সাথে না কি রাহাতের মারামারি লাগছে। আমাকে দেখতে যেতে বলেছে।"
"মারামারি আবার দেখতে যাওয়ার কী আছে?"
"আছে আছে, অনেক কিছু আছে, তুই বুঝবি না। তুই এখন খাট থেকে নাম।"
"খাট থেকে নামবো কেন?"
"দরজা খোলা রেখে যাব আমি?"
"খোলা রেখে যাবি কেন? তালা মেরে যা।"
"তালা খুঁজে পাই না। তুই ভিতর থেকে দিয়ে রাখবি। তারপর দরজার কাছেই বসে থাকবি। আমি দ্রুত এসে পড়ব। নাম, নাম।"
সাব্বির খাট থেকে নামিয়েই ছাড়লো সানজুকে। এনে সদর দরজার সামনে একটা চেয়ার পেতে বসিয়ে দিলো ওকে। বললো,
"এখানেই বসে থাকিস কিন্তু। আমি এই যাব, আর এই আসবো। বেশি বুঝে হাঁটা চলা করে ব্যথা আরও বাড়িয়ে আমায় বকা খাওয়াস না, বুঝলি?"
সাব্বির বেরিয়ে পড়লো ছাতা মাথায়। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। সাব্বির যেতে যেতে বললো,
"ভালো করে দরজা আটকে দে।"
সানজু দরজা বন্ধ করে দিলো। চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
"পাগল ভাই পেয়েছি একটা... তবুও বেশ ভালো।"
কিছুক্ষণ পর দরজায় কড়াঘাতের শব্দ হলো। সানজু বসে বসেই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। কড়াঘাতের শব্দে একটু কেঁপে জেগে উঠলো। যখন বুঝলো দরজায় শব্দ হচ্ছে তখন বললো,
"আসছে নবাবজাদা। এই না কি ওনার 'এই যাওয়া আর এই আসা'।"
সানজু উঠে দরজা খুললো।
আগন্তুকে দেখে মুখের রক্ত সরে গেল সানজুর।
আব্বাস ভাই!
সানজু ভীষণ ভাবে চমকালো। এ সময় আব্বাস ভাই এখানে কী করে? সানজু ভীত চোখে তাকিয়ে রইল আব্বাসের দিকে।
আব্বাস একটু হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু হাসতে পারলো না। চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করলো,
"কেমন আছো, সানজু? ভালো আছো?"
"বাড়িতে কেউ নেই, আপনি পরে আসেন।" কথাটা বলতে বলতে সানজু দরজা আটকাতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। আব্বাস দরজার কপাটের গায়ে শক্ত করে হাত রেখে থামালো। বললো,
"বাড়িতে কেউ নাই সেইটা আমি ভালো কইরাই জানি। আর কারো থাকনের দরকারও নাই। আমি তোমার লগে কথা কইতে আইছি। আর আমার কথা শেষ না হওনের আগে দরজা আটকানোর মোটেও চেষ্টা করবা না। তাইলে তার ফল মোটেই ভালো হইবো না।"
সানজুর সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে রাগে। সাথে ভয়। কিন্তু নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রেখে বললো,
"কী কথা বলবেন আপনি?"
"ওই পোলার লগে এত কী তোমার? কী রং-ঢং চলতেছে ওই পোলার লগে?"
"কার কথা বলেন আপনি? আর কীসের রং-ঢং?"
"ওই বেজন্মাডার কথা কইতাছি। লটাইয়া বেড়াও ওই শালার লগে তাই না? তাও আবার একজন না। দুই বইনেই লটাও। আর সব থেকে বেশি লটাও তুমি!...কই, আমি আইলে তো ফুড়ুৎ ফারুত কইরা এদিক ওদিক দিয়া উইড়া যাও। কথা কও না আমার লগে, সময় দিতে পারো না একটু, বই লইয়া রুমে বইসা থাকো। আর ওই হারামিডার লগে হা হা হি হি চলতেই থাকে! আর শুধু তাই না। হাত ধরাধরি, গা ঘেঁষাঘেঁষি কোনোডাই তো বাদ যায় না।"
"মুখ সামলিয়ে কথা বলেন আব্বাস ভাই। এগুলো কোন ধরণের ব্যবহার? অসভ্যতামির একটা লিমিট থাকা দরকার। আজকে নিজের সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছেন আপনি!"
"তুমি নিজেই তো সীমা অতিক্রম কইরা ফেলছো, অন্যেরে আর কী সীমা দেখাইবা তুমি? কী ভাবছো? আমি কিছু জানি না, শুনি না, তাই না? লোক লাগাইয়া তো সবই শুনলাম তোমগো কিচ্ছা-কাহিনী। আর ওইদিন তো নিজের চোখেই দেখলাম। নৌকায় ঘুরতে গেছিলা সবাই ওই শালারে নিয়া, তাই না?
আসলে তোমগো পরিবারডাই হইলো পাগলের কারখানা। একেকজন বদ্ধ উন্মাদ তোমরা! আর সব থেকে বেশি পাগল হইলো ওই মন্টু। তোমগো ভাই বোন কয়ডারে আদব কায়দা তো শেখায়ই না, বরং আরও লটাইয়া বেড়ানোর পথ খুইলা দেয়..."
সানজুর আর সহ্য হচ্ছে না এইসব। আব্বাসের কথা শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার করে বলে উঠলো,
"চুপ করেন...অনেক বেশি কথা বলে ফেলছেন। আর একটা কথা যদি বলেন, তাহলে সব বলে দেবো আব্বাকে। আর, মন্টু কাকাকে নিয়ে এসব কথা বলার যোগ্যতা আপনার নেই। দশ বার জন্ম নিয়েও মন্টু কাকার মতো হতে পারবেন না।"
আব্বাস হেসে বললো,
"আব্বারে কবা? হ কও তোমার আব্বারে। তোমার আব্বাও তো হইছে আরেকখান বজ্জাত! নাটের গুরু। সেই কবে তোমার লগে আমার বিয়া দিবো বইলা কথা দিছে, অথচ অহন কিচ্ছু মনে নাই তার। বিয়া দেওনের নাম গন্ধও লইতাছে না..."
"আমার আব্বা কখনও কোনো কথা দেয় নাই যে, আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে। আপনারা নিজেরাই কথা সাজিয়ে বসে আছেন। কী করে ভাবলেন যে আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে? কে বিয়ে করবে আপনাকে? আপনাকে বিয়ে করার থেকে তো মরে যাওয়াও ভালো...আহ..."
সানজুর কথা শেষ হতে না হতেই আব্বাস এক হাত দিয়ে সানজুর দুই গাল চেপে ধরলো। সানজুর গাল বিষিয়ে উঠছে ব্যথায়। আব্বাস কটমট করে বললো,
"তুমি কী ভাবছো? তোমারে বিয়া না করলে আমি মইরা যামু? আরে, তুমি কী বিয়া করবা না আমারে, আমি নিজেই বিয়া করুম না তোমারে। এই মুহূর্তে তোমারে ত্যাগ করলাম। তোমার মতো একটা দুশ্চরিত্রা মাইয়ারে কে বিয়া করবো? একটা পোলার লগে লটাইয়া বেড়াও সারাক্ষণ, আবার..."
সানজু আব্বাসের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগে চিৎকার করে বলে উঠলো,
"হ্যাঁ সারাক্ষণ লটাইয়া বেড়াই। কী করবেন আপনি? দরকার হলে ওনার জন্য মরে যাব আমি। কী করবেন আপনি? কী করবেন?"
আব্বাস রাগে দিশেহারা হয়ে আবারও সানজুর গাল চেপে ধরলো। জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বললো,
"খুন কইরা ফালামু তোমারে, খুন..."
সাব্বির প্রবেশদ্বার পেরিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। ঘরের দরজায় চোখ পড়তেই আতঙ্কিত হলো। এসব কী হচ্ছে? সানজুকে কি মারছে? সাব্বির দৌঁড়ে ছুটে আসলো। এসেই আব্বাসের হাত সরিয়ে দিলো। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
"কী করছেন আব্বাস ভাই? সানজুর গাল চেপে ধরেছেন কোন সাহসে? পাগল হয়ে গেছেন?"
"ওর তো কপাল ভালো যে ওরে ধইরা থাপ্পড় মারি নাই। লোকের লগে পিরিত কইরা বেড়ায়, আর আমার লগে কথা কওনের সময় পায় না..."
"হ্যাঁ পিরিত করি, দরকার হলে ভবিষ্যতে ওনাকে বিয়েও করবো। তাতে আপনার কী?"
বলে উঠলো সানজু। গলায় বেশ জোর দিয়ে বললো কথা গুলো।
সাব্বির অবাক হয়ে বললো,
"কী বলছিস এসব? কাকে নিয়ে কী বলছিস?"
আব্বাস মাথাটা একটু সানজুর দিকে এগিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,
"ভুল করলা কিন্তু, চরম ভুল। তোমারে আর বিয়া করন যাইব না। দুশ্চরিত্রা মাইয়ারে কিছুতেই বিয়া করুম না আমি। আইজকা সব শ্যাষ তোমগো লগে। দুই চার এলাকার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী আর চরিত্রবান মাইয়াডারে বিয়া কইরা দেখাইয়া দিয়াম তোমগো। খুঁজতে একটু সময় লাগব, নয়তো আইজকাই বিয়া কইরা দেখাইয়া দিতাম। মনে রাইখো চরম ভুল করলা তোমরা।"
আব্বাস রাগে ফুঁসতে, ফুঁসতে দ্রুত পায়ে জায়গা ত্যাগ করলো।
সানজু কাঁপছে। দিশেহারা লাগছে। কিছুক্ষণ আব্বাসের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে, দু হাতে মুখ ঢেকে চোখ-মুখ খিঁচিয়ে কেঁদে উঠলো সানজু।
সাব্বির পড়লো মহা বিপাকে। ভীষণ অপরাধ বোধ হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে, সে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল বলেই আজ এত কিছু হলো। সাব্বির সানজুকে শান্ত করার জন্য বললো,
"চিন্তা করিস না, এর একটা বিহিত করেই ছাড়বো আব্বাকে বলে। আমার বোনের গায়ে হাত তুলে পার পেয়ে যাবে ভেবেছে? ওর হাত ভেঙ্গে দেবো।"
সানজু কান্না থামিয়ে চোখ তুলে তাকালো সাব্বিরের দিকে। সাব্বির দেখলো সানজুর দুই গাল লাল হয়ে গেছে। সাব্বিরের ইচ্ছে হলো এখনই গিয়ে আব্বাসের গালে দুইটা দশ মণ ওজনের চড় মেরে আসে। সাব্বির অপরাধী কণ্ঠে বললো,
"স্যরি আমি! আমার উচিত হয়নি তোকে একা রেখে বাইরে যাওয়া। আমি সত্যিই ভাবতে পরিনি এসব..."
সাব্বির কথা শেষ করার আগে সানজু বললো,
"ভাইয়া আমার ভালো লাগছে না কিছু। আমি রুমে যাই।"
"চল আমি নিয়ে যাই।"
সাব্বির সানজুকে রুমে নিয়ে এলো। সানজু বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। সাব্বির জিজ্ঞেস করবে না, করবে না করেও জিজ্ঞেস করলো,
"আচ্ছা কী বিষয়ে ঝগড়া হয়েছিল তোদের? বিয়ে, পিরিত সেসব কী ছিল? কাকে নিয়ে কথা বলছিলি তোরা?"
সানজু কিছু বললো না। কীভাবে বলবে শৌখিনের কথা! শৌখিনকে নিয়ে এমন কথা হচ্ছিল শুনলে কী মনে করবে সাব্বির! রাগের মাথায় আব্বাসের সাথে তাল মিলিয়ে কীসব বলে ফেলেছে। লজ্জায় সানজুর এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে!
সাব্বির বুঝতে পারলো, সানজু উত্তর দেবে না। বললো,
"ঠিক আছে রেস্ট নে তুই। আমি যাই। আব্বা আর মন্টু কাকা আজকে বাড়িতে আসুক। তারপর দেখিস, ওই শালা আব্বাসের নেতামি কীভাবে ছুটিয়ে দিই।"
সাব্বির রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সানজু বললো,
"ভাইয়া, থাক। আপদ তো নিজ থেকেই বিদায় হয়েছে। এখনই বাবার কাছে এসব বলার দরকার নেই। তারা শুনলে তোকে খুব বকাবকি করবে। কেন বাইরে গিয়েছিলি সেটাই তাদের বুঝিয়ে বলতে পারবি না তখন।
ওই খবিশটা পরে আবার কিছু করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে তার। খবিশটা তো বিয়ের কথা বলে গেল। এখন আগে দেখি কী করে সে!"
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ১৭ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
মন্টু সবার দিকে একবার চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে বললো,
"কী? তোমরা আমায় রেখে পাত্রী দেখতে গিয়েছিলে? আম্মা, ভাইজান যা বলছে তা কি সত্যি? তোমরা সত্যিই পাত্রী দেখতে গিয়েছিলে আমায় না জানিয়ে?"
পারভেনু বিবি মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হ রে বাপ গেছিলাম।"
মন্টু বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল।
"আমায় না জানিয়ে এত বড়ো একটা কাজ কীভাবে করলে তোমরা? ঝন্টুকে একা একা নিয়ে চলে গেলে কী করে? আমায় কি এ বাড়ির মানুষ ভাবো না? আমার কি কোনো মতামত নেই? আমি কি ভেসে এসেছি?
না, না থাকবো না। আর থাকব না এই বাড়িতে। এই আমি গেলাম। থাকো তোমরা ইচ্ছা খুশি মতো। যা মনে ধরে তাই করে বেড়াও। আমি কে? কোত্থেকে এসেছি? কী হই তোমাদের? কিচ্ছু হই না তোমাদের। জীবনে কেউ একটু পরোয়া করলে না কোনো দিন! না আর কিছুতেই থাকব না এই বাড়িতে। যেখানে আমার কোনো মূল্য নেই সেখানে কী করে থাকব? গেলাম। গেলাম আমি।"
মন্টু কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘটঘট করে নিজের ঘরে চলে এলো।
এসেই ব্যাগের ভিতর নিজের সব জামা কাপড় ভরতে শুরু করলো। সত্যিই আজ চলে যাবে সে। এতদিন বাড়ি ছেড়ে গেলেও আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু আজ গেলে জীবনেও আর ফিরে আসবে না। আর ফিরে আসবে না বলেই নিজের জামা কাপড়ও নিয়ে যাবে।
মন্টু জামাকাপড় প্রায় ব্যাগ ভরে ফেলেছে। একটা ব্যাগে হবে না, আরও লাগবে। মন্টু খাটের নিচ থেকে আরও একটা ব্যাগ বের করলো। সেটায় একটা টি শার্ট রাখতেই আগমন ঘটলো চাঁদনীর। চাঁদনী সাথে করে দুই পাত্রীর দুটো ফটোও নিয়ে এসেছে। চাঁদনীকে দেখেই মন্টু বললো,
"কী রে, এখানে কী চাই তোর? তোরা সবাই-ই হলি বেইমান! খুব তো নাচতে নাচতে তুইও পাত্রী দেখতে গিয়েছিলি। কই, যাওয়ার আগে এই মন্টু কাকাকে কি একটু মনে পড়েছিল? আসলে, আমিই সবাইকে আপন ভাবি, তোরা কেউ আমায় আপন ভাবিস না। যদি
আপনই ভাবতি, তাহলে যাওয়ার আগে তুই অন্তত একবার আমায় জানাতে পারতি। কিন্তু তুইও সবার সাথে তাল মিলিয়ে কিছু জানালি না আমায়। তোদের সবাইকে আজ চেনা হয়ে গেল। থাক তোরা তোদের মতো। মন্টু নামে তোদের একটা কাকা ছিল, সেটা আর মনে রাখার দরকার নেই!"
মন্টু দ্রুত নিজের হাত চালাচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব জিনিসপত্র গুছিয়ে চলে যাবে সে। এই বেইমানদের সাথে আর এক মুহূর্তও থাকার ইচ্ছা নেই।
চাঁদনী বললো,
"উফ, মন্টু কাকা, তুমি যে এরকম বিরক্তিকর একজন মানুষ সেটা তো আগে বুঝতে পারিনি।
এত চ্যাটাং চ্যাটাং না করে, একটু ধীরে সুস্থে কথাটা শোনো দেখি..."
"কিচ্ছু শুনবো না আমি। তোদের কথা শোনার আর কোনো ইচ্ছা নেই। তোরা সবাই হলি আমার পর। তোদের আপন ভেবে ভুল করেছিলাম। তোরা সবাই হলি একেকজন বিষধর কাঁটা। কিন্তু আমি তোদের ফুল ভেবে বসেছিলাম। তবে, আজ আমার চোখ খুলে গেল। চলে যা এখান থেকে তুই। আমার যাওয়া কেউ থামাতে পারবি না। আমি চলে যাবই বাড়ি থেকে। তোদের মতো মানুষের সাথে থেকে বার বার কাঁটার আঘাত খেতে পারব না আমি।"
চাঁদনী ভাব নিয়ে বললো,
"চলে যেতে চাও যখন, তখন যাও। কিন্তু চলে গেলে কিন্তু তোমারই ক্ষতি হবে মন্টু কাকা। তাই বলছি, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরো না। চলে যখন যাবেই, তার আগে পাত্রীর ছবি দুটো দেখে যাও।"
মন্টু চাঁদনীর দিকে গরম চোখে তাকিয়ে বললো,
"চাঁদনী, তুই কি আমার কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে এসেছিস?"
"না গো, নুনের ছিটা দিতে আসিনি, মরিচের গুঁড়া মাখিয়ে দিতে এসেছি তোমার গায়ে।"
মন্টু হাঁক ছেড়ে বললো,
"বেরিয়ে যা এখান থেকে। পর সারা জীবন পরই থাকে, কোনো দিনও আপন হয় না।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ আমরা তো পরই। পর হয়েও তো তোমার কথা ভাবী। আর ভাবী বলেই তো, ঝন্টু কাকার একার বিয়ে ঠিক করতে পারলাম না, তোমরটাও ঠিক করে এলাম।"
চাঁদনীর ধারণা ছিল মন্টু কথাটা শুনে খুশি হবে। কিন্তু না, মন্টু গর্জে উঠে বললো,
"হ্যাঁ? কী বললি? কী বললি তুই?"
"তোমার বিয়েটাও ঠিক করেছি সেটাই তো বললাম। এই যে পাত্রীর ছবি..."
চাঁদনী হাতের ফটো দুটো এগিয়ে দিলো মন্টুর দিকে।"
কিন্তু মন্টু সেদিক তাকিয়েও দেখলো না। না দেখেই কিছুটা টেনে বললো,
"ও-হো ভালোই প্ল্যান করেছিস তোরা! আমায় মাঝ নদীতে ডুবিয়ে মারার প্ল্যান সব তৈরি করে ফেলেছিস না কি? একটা ন্যাংড়া, লুলা মেয়েকে আমার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিতে চাইলেই কি আর আমি মেনে নেবো? কোন সাহসে আমার বিয়ে ঠিক করলি তোরা? আমায় কিছু না জানিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করলি কোন সাহসে?"
মন্টু রাগে গজগজ করতে করতে ঝড়ের বেগে রুম থেকে বের হলো। কী পেয়েছে তাকে? সবাই তাকে নিয়ে খেলা করছে? আজ এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে সে!
মন্টু আবার হলরুমে এলো। সবাই হলরুমেই উপস্থিত ছিল। চাঁদনীও মন্টুর পিছন পিছন দৌঁড়ে উপস্থিত হলো হলরুমে। মন্টু এসেই বললো,
"কী পেয়েছো কী তোমরা আমায়? আমাকে কি মানুষ ভাবো না? আমি কি একটা কাঠের পুতুল? যে যখন খুশি আমাকে নাচিয়েই যাবে? কোন সাহসে আমায় না জানিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করলে? ল্যাংড়া লুলা একটা মেয়ে এনে গলায় ঝুলিয়ে দেবে, আর সেটা ধরে আমি বসে থাকবো ভেবেছো?"
"কে বললো তোকে যে, আমরা একটা ল্যাংড়া লুলা মেয়ে ঝুলিয়ে দেবো তোর গলায়?"
শান্ত কণ্ঠে বললেন সাবের সাহেব।
"বলতে হবে কেন? আমি কি কিছু বুঝি না? ইচ্ছে করে এই প্ল্যান করেছো তাই না? আমার পছন্দ অপছন্দের মূল্য নেই?"
"মন্টু কাকা, ঘোড়ার ডিম বোঝো তুমি।"
পিছন থেকে বলে উঠলো চাঁদনী।
মন্টু চকিতে ঘুরে তাকালো চাঁদনীর দিকে।
চাঁদনী বললো,
"আমরা কোনো ল্যাংড়া লুলা মেয়ে দেখিনি তোমার জন্য। সুস্থ স্বাভাবিক মেয়েই দেখেছি। তাও আবার রূপসী। তোমার পছন্দ অপছন্দের অবশ্যই মূল্য পাবে তুমি। এই দেখো..."
চাঁদনী হাতের ফটো দুটো মন্টুর সামনে ধরলো।
মন্টু ছোঁ মেরে ফটো দুটো নিয়ে এলো চাঁদনীর হাত থেকে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
"মাশা আল্লাহ।"
মন্টুর এমন কথায় সবাই হাসলো।
মন্টু কয়েক মিনিট পর অবাক কণ্ঠে বললো,
"কিন্তু দুইটা মেয়ের ছবি কেন? তোমরা কি দুইটা মেয়ের বিয়ে দিতে চাও আমার সাথে?"
"আরে দুইডা মাইয়ার বিয়া দিমু ক্যান তোর লগে? তোর যে মাইয়াডারে পছন্দ হইবো, হের লগেই তোর বিয়া দিমু। আর মাইয়াডার লগে ঝন্টুর বিয়া হইবো।" পারভেনু বিবি বললেন।
মন্টু ফটো দুইটা দুই হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে নাটিয়ে দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ আগেও যে সে এত এত কথা শোনালো সবাইকে, তা বেমালুম ভুলে গেছে সে। মন্টু খানিক পর্যবেক্ষণ করে, বাম হাতে থাকা ফটো খানার দিকে তাকিয়ে বললো,
"এই মেয়েটা বেশি সুন্দর।"
পারভেনু বিবি বললেন,
"কই দেহি..."
মন্টু ফটোটা এগিয়ে দিলো। পারভেনু বিবি একটু হাসলেন। এই মেয়েকেই মন্টুর সাথে ঠিক করে রেখেছেন সবাই। মন্টুর গোলগাল ফর্সা চেহারার সাথে এই মেয়ে একদম পারফেক্ট।
মন্টু দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললো,
"মেয়ে দুটোকে বাচ্চা বাচ্চা লাগে কেন? বয়স কত এদের? বাল্য বিয়ে টিয়ে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করোনি তো আবার?
শুনে রাখো, আমি কোনো বাল্য বিবাহের মধ্যে নেই।"
সাবের সাহেব বললেন,
"আরে না, বিশ বছরের মেয়ে।"
"কিন্তু দেখলে তো মনে হয় সানজু চাঁদনীর বয়সী।"
"ছবিতে অমন দেখাচ্ছে। সামনা সামনি দেখলে বড়ো লাগবে।"
"তাই?" মন্টুর মনে এখনও সংশয় রয়ে গেল।
________________
আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি নামবো, নামবো করছে। এখন সকাল দশটা বাজে। চাঁদনী স্কুলে গেছে। সানজুর পায়ে ব্যথা তাই যায়নি। না এটা বোধ হয় ভুল কথা। সানজু ইচ্ছা করেই যায়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটেও স্কুলে যাওয়া যেত, বিশেষ একটা কারণে এত রিস্ক না নিয়ে বাড়িতেই থেকে গেছে। সাব্বির কলেজে। মন্টু, ঝন্টু ঘেরে মাছ ধরছে। শৌখিন যেতে চেয়েছিল তাদের সাথে, কিন্তু হেলেনা যেতে দিলেন না। উনি সকালে পিঠা বানিয়েছিলেন, সেটা খেয়ে তবেই যেতে বলেছে শৌখিনকে। সাবের সাহেব বাজারে গেছেন। হেলেনা আর পারভেনু বিবি রান্না ঘরে বসে কলমি শাক, পুঁই শাক কুটছেন, আর গল্প করছেন।
সানজু আনমনে ছাদে বসে আছে। বাতাসে চুল গুলো উড়ছে। কিছু ভালো লাগছে না তার। কালকে আব্বাসের সাথে ঝগড়া হওয়ার পর থেকে কিছুই ভালো লাগছে না আর। অস্বস্তি দায়ক মনে হচ্ছে সব কিছু। সানজু বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেললো। যদি এই নিঃশ্বাসের সাথে সাথে সব অস্বস্তি, হতাশাও বেরিয়ে যেত...
তবে কালকের ঘটনা থেকে সানজু স্পষ্ট ভাবে একটা জিনিস উপলব্ধি করতে পারলো। সেটা হলো, শৌখিনকে সে আসলেই পছন্দ করে। খুব বেশি পছন্দ করে। কিন্তু কেন করে?
কোনো কারণ আছে তাকে পছন্দ করার? যে লোকটার নাম, পরিচয় কিছুই জানে না, সে লোকটাকে পছন্দ করার কারণ কী? না কোনো কারণ নেই। লোকটাকে পছন্দ করার কোনো কারণ নেই। তবুও তাকে পছন্দ করে সানজু। বিনা কারণে পছন্দ করে...
কারো চাপা কাশির আওয়াজে সানজুর ভাবনা থমকে গেল। সানজু ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরলো। শৌখিনকে দেখে ভালো লাগলো তার। পিছনে না তাকিয়েই মনে হয়েছিল শৌখিন এসেছে। কী করে বুঝলো যে এই লোকটাই এসেছে? মনের টানে?
এমন অযোক্তিক ভাবনার কারণে সানজু নিজেই নিজের প্রতি বিরক্ত হলো। এসব কী ভাবছে সিনেমাটিক!
সানজু বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মনে মনে স্বাভাবিক হয়ে তাকালো শৌখিনের দিকে। শৌখিনকে আজ অন্য রকম লাগছে। মনে হচ্ছে দোটানায় ভুগছে। সানজু চোখ সরু করে দেখলো শৌখিনকে। শৌখিন নিজের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ভাবছে সে। সানজু যেন ধরতে পারলো শৌখিন কী নিয়ে ভাবছে। সানজুর মুখে অজান্তেই একটু হাসি ফুটলো। মনে অনুভব করলো এক ধরনের তৃপ্তি। আর সেই তৃপ্তি থেকেই বললো,
"অবশেষে আপনার সময় হলো, আমাকে বলার।0"
শৌখিন অবাক হয়ে তাকালো সানজুর দিকে।
"কী করে বুঝলেন?"
"মন বললো। ধারণা করেছি আমি। কিন্তু এটা শুধু ধারণা নয়, আপনি সত্যিই বলতে এসেছেন আজকে। অবশেষে নিজের ইচ্ছাতেই নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে এসেছেন। বলুন, শুনতে চাই আমি।"
সানজু প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাকানো শৌখিনের দিকে।
শৌখিন কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে বললো,
"আমি বললেই কি আপনি বিশ্বাস করবেন?"
"করবো।"
"করবেন?" শৌখিন সানজুর কথায় যেন ঠিক ভরসা খুঁজে পেল না।
সানজু আবার বললো,
"যা বলবেন তাই বিশ্বাস করবো।"
"অবিশ্বাস্য কিন্তু।"
"হোক। যত অবিশ্বাস্যই হোক না কেন আমি বিশ্বাস করবো। আপনি শুধু বলেন।"
শৌখিন সাথে সাথে কিছু বললো না। খানিক চুপ থেকে বললো,
"যদি বলি, আমি অন্যসব মানুষের মতো সাধারণ নই, তাহলে বিশ্বাস করবেন?"
"করব।"
"যদি বলি, যে ভাষাটা কোনো দিন আমার বোধগম্য ছিল না। এমনকি আগে আমি শুনিওনি কখনো। কিন্তু সেটা কয়েক বার মনোযোগ দিয়ে লোকের মুখ থেকে শুনলে আমার আয়ত্ত হয়ে যায়, আমি স্পষ্ট ভাবে খুব সুন্দর করে সেই ভাষায় কথা বলতে পারি, তাহলে বিশ্বাস করবেন?"
সানজু একটু থমকে গেল। এমনটা কি সম্ভব? না, কিছুতেই এমন হতে পারে না! কিন্তু তারপরও সানজুর মনে হলো লোকটা সত্যি বলছে। মন বলছে এই কণ্ঠে এতটুকু মিথ্যার ছোঁয়া নেই। কথাটা অবিশ্বাস্য হলেও সানজু বললো,
"হুম, বিশ্বাস করব।"
শৌখিন আবার বললো,
"যদি বলি, আমি একেকটা বছর একেকটা ভিন্ন ভিন্ন দেশে যাই। তাও আবার বিনা পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিটে, তাহলে বিশ্বাস করবেন?"
সানজুর মন মানতে চাইছে না কথাটা, কিন্তু তার মাথাটা যেন এক যান্ত্রিক শক্তিতে হ্যাঁ সূচক ভাবে নড়ে উঠলো।
"যদি বলি, আমি একেক বছর এক এক দেশের মানুষের সাথে মিলিয়ে একেক চেহারায় থাকি। যেমন- কখনো আমি আমেরিকান, কখনো সাইবেরিয়ান, কখনো আফ্রিকান, কখনো এরাবিয়ান, কখনো চাইনিজ। চেহারা একেবারে পুরোপুরিও পাল্টে যায় না। আবার কমও পরিবর্তন হয় না। চুল, চোখ গায়ের রং এগুলো পরিবর্তন হবেই। তাহলে বিশ্বাস করবেন?"
সানজুর মন ঘোর বিরোধীতা করে বলে উঠলো,
"অবিশ্বাস্য! এটা হতেই পারে না!"
কিন্তু মুখে বললো,
"করবো বিশ্বাস।"
"যদি বলি, বৃষ্টিতেই আমার সব। আমার সকল অস্তিত্ব বৃষ্টির মাঝেই খুঁজে পাই। জন্ম, জীবনধারা সব কিছু। তাহলে বিশ্বাস করবেন?"
সানজুর অবাক হওয়ার মাত্রা বেড়েই চলছে শুধু। বৃষ্টিতেই একটা মানুষের সব কিছু কীভাবে হতে পারে? অস্তিত্ব, জন্ম, জীবন ধারা!
মুখে বললো,
"করবো বিশ্বাস।"
"যদি বলি, আমি একেকটা বছর একেকটা দেশে শুধু মাত্র ২৮ টা দিন থাকতে পারি। তাও শুধু বৃষ্টির প্রথম মৌসুমে। তারপর আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়! তারপর আর আমার কিছুই মনে থাকে না! আবার পরের বছর অন্য একটা দেশে বৃষ্টির মাঝে আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। তাহলে বিশ্বাস করবেন?"
সানজুর হৃদয় কেঁপে উঠলো। সে অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো শৌখিনের দিকে। কিছু বলতে পারল না।
শৌখিন এভাবে তাকাতে দেখে বললো,
"কী? বিশ্বাস করতে পারছেন না?"
সানজুর মনে হলো সে ঠিক ভাবে শ্বাস নিতে পারছে না। দম বন্ধ, বন্ধ লাগছে। অক্সিজেনের ব্যাপক অভাব টের পেল সে এই মুহূর্তে। সানজু অবিশ্বাসের জাল জড়িয়ে কোনো রকম মাথা নাড়িয়ে বললো,
"করি বিশ্বাস।"
শৌখিন এক টুকরো কষ্ট বুকের মাঝে চেপে রেখে শান্ত কণ্ঠে বললো,
"যদি বলি একদিন আমায় চলে যেতে হবে! আমার সময় আছে খুব অল্প! তারপরই আবার আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে! বিশ্বাস করবেন এসব?"
সানজু অনুভব করলো সত্যি সত্যিই তার দম বন্ধ হয়ে গেছে। সে শ্বাস নিতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে হৃদয়ে। ভীষণ কষ্ট! ক...ক্ক...কী বললো লোকটা? চ... চলে যাবে মানে? সানজুর চোখে অশ্রু চিকচিক করে উঠলো। কিন্তু এ অশ্রু যে কাউকে দেখানো যাবে না। এ অশ্রু যে বেমানান। তার চোখে এই অশ্রু মানায় না! সানজুর চোখের অশ্রু বেরিয়ে আসতে চাইছে বাঁধ ভেঙ্গে। কিন্তু সানজু সেটা চোখের মাঝেই বন্ধি রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে কাঁপা স্বরে বললো,
"ক...করি। করি বিশ্বাস।"
শৌখিন সানজুর অশ্রুসিক্ত ঘোলাটে চোখের দিকে পলক হীন তাকিয়ে থেকে বললো,
"যদি করেনই তাহলে, এটাও মানুন যে, আমার বলা 'যদি' কথা গুলোই আমার জীবনের চিরন্তন সত্য ধারা। এগুলোই আমার নিয়তি!"
সানজুর পা জোড়া নিজেদের শক্তি হারিয়ে ফেলছে। মনে হচ্ছে এখনই বসে পড়বে ধপাস করে। কিন্তু সানজু নিজেকে কোনো রকম ভাবে সামলে দাঁড়িয়ে রইল। শৌখিনকে কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু বলতে পারল না। কোনো কথা বের হলো না মুখ থেকে।
শৌখিন বলতে শুরু করলো,
"আমি যখন যেই দেশে থাকি, সেখানেই আমি মানিয়ে নিতে পারি অনায়াসে। আমার চেহারা, ভাষা সব ওই দেশের মানুষদের মতোই থাকে। এমনকি আমি প্রত্যেক বার এক একটা ঘরে গিয়েই থাকি। প্রথম যেই ঘরে গিয়ে উঠি, সেই ঘরের লোকজনই আমায় আপন করে নেয়। দিন গুলো সেই পরিবারের লোক গুলোর সাথেই কাটে। বিধাতা আমায় এই আশ্চর্যজনক ক্ষমতা দিয়ে, খুব ভালো রেখেছে আমায়। নয়তো নতুন নতুন অপরিচিত দেশে গিয়ে আমি কীভাবে চলতাম?
আমি যেদিন থেকে আমার এই আশ্চর্য জনক বিষয়ের উপলব্ধি করতে পারলাম, সেদিন থেকে এই বিষয়টা খুব উপভোগ্য হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। বেশ ভালো লাগতো এক এক বার নতুন নতুন দেশে গিয়ে জীবন কাটাতে। নতুন নতুন মানুষ জনের সাথে মিশতে। আমার এই অস্বাভাবিক ভাগ্য নিয়ে আমি খুব আনন্দিত ছিলাম। আমার এই জীবনের সাথে আমি বেশ মানিয়ে গিয়েছিলাম। বছরের বারোটা মাসের মধ্যে থেকে একটা মাসের জীবন ভালোই কেটে যাচ্ছিল আমার।
কিন্তু কখনো ভাবতে পারিনি, আমার এই অস্বাভাবিক জীবন নিয়ে আমাকে একদিন আফসোস করতে হবে। আপনাদের এখানে আসার কয়েক দিন পর থেকেই এই আফসোস জিনিস টার সাথে পরিচিত হলাম আমি। এখন কেবলই মনে হচ্ছে ভাগ্যটা এমন না হলেও পারতো! এই জায়গায় বাকিটা জীবন থেকে যেতে..."
শৌখিন আর কিছু বলতে পারলো না। তার গলা ধরে এলো।
সানজু অবিশ্বাস্য ভাবে চেয়ে আছে শৌখিনের দিকে। না এসব সত্যি না। কিছুতেই সত্যি হতে পারে না এইসব। কিছুতেই না। এসব শুধুই গল্প। রূপকথার গল্পের মতো এসবও মিথ্যা গল্প। সানজুর হৃদয় কেঁদে উঠছে চিৎকার করে। সানজু মনে মনে যতই নিজেকে সান্ত্বনা দিক না কেন, এইসব মিথ্যা। কিন্তু সে জানে শৌখিনের প্রতিটা কথা সত্য। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। এটা চিরন্তন সত্য। যেটা খুব ভালো ভাবে আঁচ করা যায়।
শৌখিন একটু সময় নিয়ে আবার বললো,
"আমার কিছু বিশেষ ক্ষমতাও আছে। যেমন, যেটা আমি কখনো দেখিনি, জানিও না যেটার সম্পর্কে। কিন্তু হঠাৎ করেই সেটার কথা যদি বলি, তাহলে সেটা আজব ভাবে মিলে যায়। মাঝে মাঝে এমন হয়, সব সময় না।
এই যেমন, আপনার পাখি গুলো আমি না দেখলেও, ওদের সম্পর্কে কিছু না জানলেও, ওদের কথা আমি বলেছিলাম আপনাকে।
ঠিক এমনি ভাবেই একটা ঘটনা ঘটিয়ে ছিলাম আমি। সে বার একদল হ্যাকারদের কাছে গিয়ে পড়েছিলাম। তখন নিছকই দশ-বারো বছরের একটা বাচ্চা ছিলাম আমি। বৃষ্টিতে ভেজা অবস্থায় হুট করে উপস্থিত হয়ে ছিলাম সেখানে। প্রথমে ওনারা আমাকে পুলিশের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তাদের বলেছিলাম, যাতে তারা আমাকে পুলিশের কাছে তুলে না দেয়, আমি চাইলে তাদের সাহায্য করতে পারি। তখন আমি সে দেশের একজন নামি দামি বিজনেস ম্যানের সোশ্যাল মিডিয়ার পাসওয়ার্ড বলে দিয়েছিলাম তাদের। আজব ভাবে সেটা মিলে যায়..." শৌখিন কথাটা বলে নিজেই হেসে উঠলো আনমনে। তারপর আবার বললো,
"সেই বার খুশি হয়ে তারা তাদের সঙ্গেই রেখে দিয়েছিল আমাকে। আরও অনেক সাহায্য করেছিলাম তাদের। খুব আদরেই ছিলাম তাদের কাছে। কিন্তু আমার সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম আমি। চিরতরে! এবারও..."
শৌখিনের চেহারায় আধাঁর নামলো। সে নিচের দিকে তাকিয়ে দুই চোখ বুঝে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
সানজু তখনও ছলছল চোখে শৌখিনের দিকে তাকিয়ে।
শৌখিন পরিবেশ হালকা করতে সানজুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,
"পাখিদের ওভাবে আটকে রাখবেন না। ওদের কষ্ট হয়।"
সানজুর এবার মুখ ফুটে কথা বের হলো,
"আরও একদিন বলেছেন এই একই কথা। এখন কী করবো আমি? মুক্ত করে দেবো ওদের?"
জড়ানো গলায় বললো সানজু।
"না, এখন মুক্ত করে দেওয়ার দরকার নেই। যেদিন আমি চলে যাব, সেদিন ওদের খোলা আকাশের নিচে ওড়ার স্বাধীনতা দিয়েন।"
"তার মানে আপনি সত্যিই চলে যাবেন?" সানজুর বাম চোখ বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা পানি পড়লো।
"আমি চলে যাব না, আমায় যেতে হবে! জিজ্ঞেস করতেন না, সব সময় আষাঢ়, আষাঢ় করার কারণ কী? কারণটা হলো, এই আষাঢ় শেষ হলেই আমায় চলে যেতে হবে! আমার অস্তিত্ব আপনা আপনিই বিলীন হয়ে যাবে!"
সানজু দুই চোখ বন্ধ করে ফেললো। সাথে সাথে দুই চোখ বেয়ে আরও কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সানজু বড়ো করে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। তারপর বললো,
"যদি জানতাম আপনার আসল পরিচয়ের পিছনে এসব আছে, তাহলে কখনো জানতে চাইতাম না। ভুলেও জানতে চাইতাম না।"
শৌখিন শান্ত কণ্ঠে বললো,
"আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যে আমার অস্তিত্ব, আমার অতীত, আমার বর্তমান, আমার ভবিষ্যত, আমার সব কিছু জানেন। এর আগে কখনো কাউকে বলিনি নিজের এমন অবিশ্বাস্য জীবন কাহিনী। আমার এসব আজব কাহিনী শুনে কি আপনার নিজেকে এখন ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে?"
সানজু দুই পাশে মাথা নেড়ে বললো,
"না, নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে না। বরং দুর্ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। কারণ, আমি আপনার সাথে শুধু একটা আষাঢ় পার করার আশা করিনি। আমি চাই জীবনের সব ক'টা আষাঢ় আপনার সাথে কাটাতে।"
"বুঝতে পারলাম না আপনার কথা!"
"বুঝতে হবে না। না বুঝলেই ভালো। সব থেকে ভালো হতো যদি নিজে না বুঝতে পারতাম এসব।"
কথাটা বলে সানজু আর দাঁড়ালো না, নেমে গেল ছাদ থেকে।
শৌখিন ব্যথিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল সানজুর চলে যাওয়ার পানে। সানজু আড়াল হতেই সে রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল। মনে মনে বললো,
"আষাঢ়ের আর কয়টা দিন আছে?"
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ১৮ (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু তা গায়ে লাগার মতো না। সানজু, চাঁদনী বৃষ্টিকে গায়ে না মেখেই এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। গ্রামের ইট ওয়ালা বিশাল রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে তারা। উদ্দেশ্য বাড়ি। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, তাই বাড়ি ফিরছে। সানজু হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নেমে গেল রাস্তা থেকে। রাস্তার পাশের অসমতল জমি গিয়ে মিশেছে শাপলার ঝিলে। সানজু ঝিলের পাড়ে বসে হাত বাড়িয়ে দুটো শাপলা তুলে নিলো। তারপর উঠে এলো রাস্তায়।
"এসব কোন ধরনের বাচ্চামি কারবার, আপু? তুই কি এখনও বাচ্চা?"
চাঁদনী শাপলা হাতে সানজুকে দেখতে দেখতে বললো কথাটা।
সানজু শাপলার পাপড়িতে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে বললো,
"হাঁটা শুরু কর।"
চাঁদনী আর কথা বাড়ালো না। হাঁটতে আরম্ভ করলো। ও লক্ষ্য করছে এই কয়েক দিন ধরে সানজু কেমন যেন হয়ে গেছে! নিজের রুম থেকে বেশি বের হয় না, বেশি কথাও বলে না। কিন্তু আগে তার মুখে কথা লেগেই থাকতো। হঠাৎ এমন পরিবর্তনের কারণ কী?
সানজু হাঁটতে হাঁটতে এক সময় উদাসীন ভাবে বললো,
"আমার মনটা খুব খারাপ রে, চাঁদনী!"
চাঁদনী চকিতে পাশ ফিরে বোনের মুখটি একবার দেখে নিয়ে বললো,
"কেন? এত মন খারাপ কেন?"
"বলা যাবে না।"
"কেন?"
"সব মন খারাপের গল্প সবাইকে বলা যায় না।"
চাঁদনী সানজুর মন খারাপের কারণ জানতে আগ্রহ দেখালো না। বললো,
"যখন বলবিই না, তখন আবার উঠালি কেন এই কথা?"
"দেখছিলাম, মানুষের কাছে বলে মন খারাপি একটু ভালো করা যায় না কি!"
"কী দেখলি? ভালো করতে পেরেছিস?"
সানজু দু পাশে হালকা মাথা নাড়িয়ে, হতাশ কণ্ঠে বললো,
"উঁহুম, পারিনি। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
সানজু প্রথম বারের মতো তাকালো চাঁদনীর দিকে।
"কী সিদ্ধান্ত?"
"আমি আজকে থেকে আমার মন খারাপের কারণই ভুলে যাব।"
সানজু কথাটা বলেই কিছুক্ষণ পর আবার বললো,
"আচ্ছা, আষাঢ় শেষ হতে কয়দিন বাকি রে?"
চাঁদনী ত্যাড়া চোখে তাকালো সানজুর দিকে। সানজু সামনে দৃষ্টি রেখে হেঁটেই যাচ্ছে আনমনে। চাঁদনী অবাক হয়ে বললো,
"তোদের কী হয়েছে বল তো? শৌখিন লোকটার মাথার ভূত কি তোর মাথায় ট্রান্সফার হয়েছে? সবাই আষাঢ় নিয়ে পড়লি কেন?"
সানজু উদাসী কণ্ঠে বললো,
"আমরা আষাঢ়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, তাই না?"
"হুম।"
সানজুর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
___________
খাবার টেবিলে সবাই উপস্থিত। সবাই নিজেদের খাবার নিয়ে ব্যস্ত। কেউ খেয়াল করছে না যে, সানজু খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শুধু শৌখিনকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। সানজু ধীরে ধীরে লোকমা তুলছে মুখে, আর শৌখিনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে,
'লোকটা কি একটু আস্তে ধীরে খেতে পারে না? সবার সাথে তাল মিলিয়ে কেন খেতে হবে? এত কীসের তাড়া তার?'
সানজুর মনের ভাবনা শেষ হতে না হতেই আজব ভাবে শৌখিনের খাওয়ার গতি ধীর হয়ে গেল। সানজুর চোখ কপালে উঠলো। সানজু চকিতে চোখ নামিয়ে ফেললো শৌখিনের থেকে। তার চোখের দৃষ্টি অশান্ত হয়ে এদিক থেকে ওদিকে ছুটছে। ব্যাপারটা কী হলো? উনি কি মনের কথা পরে ফেললেন না কি? কিন্তু উনি তো সেদিন এমন কিছু বলেননি, যে উনি মানুষের মনের কথাও নিমেষে পড়ে ফেলতে পারেন!
সবার খাওয়া শেষ হলো। কিন্তু সানজু আর শৌখিনের প্লেটে এখনও অনেক ভাত পড়ে আছে। হেলেনা যাদের খাওয়া শেষ হলো তাদের এটো প্লেট গুলো নিয়ে কল পাড়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় সানজুকে বলে গেলেন, দ্রুত খাওয়া শেষ করে তাদের দুজনের প্লেট যেন কল পাড়ে নিয়ে যায়।
খাবার রুমে এখন শুধু সানজু আর শৌখিন উপস্থিত। সানজু ইতস্তত করে নিচু কণ্ঠে বললো,
"আচ্ছা, আপনি কি মানুষের মনের কথাও পড়তে পারেন?"
"কেন? আমি কি আপনার মনের কথা পড়ে ফেলেছি?"
সানজু থতমত খেয়ে গেল।
"না, না আমি সেরকম কিছু বলিনি। আপনি তো অনেক ক্ষমতাই পেয়েছেন, তো ভাবলাম এটাও করতে পারেন কি না...এটা কেবলই আমার জানার কৌতূহল। আর কিছুই না।"
শৌখিন ভাত মাখাতে মাখাতে বললো,
"না, ওই ক্ষমতা এখনও পাইনি। তবে কয়েক জনের মনের কথা পড়লেও পড়ে ফেলতে পারি, যদি নিজে মন থেকে চাই তো।"
কথাটা শৌখিন শুধুই সানজুকে দুশ্চিন্তায় ফেলতেই বললো।
সানজুর চোখ আবারও কপালে উঠলো। বলে কী লোকটা? মনের কথা পড়লেও পড়ে ফেলতে পারে মানে? সানজু শুকনো ঢোক গিললো। এমন হলে তো খুবই বিপদ! সানজুর মনে তো কত কথাই জমে আছে। সেগুলো যদি সব লোকটা পড়ে ফেলে তখন? বিশেষ করে, তাকে পছন্দ করার কথাটা যদি কোনো রকম ভাবে ধরতে পারে, তাহলে? ইশ, তাহলে তো সে শিওর হয়ে যাবে তার ধারণাটা সঠিক ছিল!
শৌখিনের খাওয়া শেষ। সে প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সানজু সবে হাত ধুচ্ছে। শৌখিনের ওই কথা শোনার পর আর ভাত নামলো না গলা দিয়ে। কত গুলো ভাতের ভিতরই হাত ধুঁয়ে উঠলো সানজু। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতেই দেখলো শৌখিন একেবারে পাশে এসেই দাঁড়িয়েছে। শৌখিন সানজুর দিকে এক হাত বাড়িয়ে বললো,
"দিন, প্লেটটা আমাকে দিন। আমি নিয়ে যাচ্ছি।"
সানজু শৌখিনের প্লেটটা নিজের হাতে এনে বললো,
"থাক, আপনাকে কাজ করতে হবে না। ক'দিনই বা আছেন আর? আরাম আয়েশ করেই সময় কাটান। নয়তো বলবেন, আপনি চলে যাবেন জানা সত্ত্বেও এত এত কাজ করালাম আপনাকে দিয়ে।"
সানজু মুখে স্বাভাবিক ভাবে কথা গুলো বললেও, ভিতরে ভিতরে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে!
শৌখিনের মনে কালো মেঘেরা ছেয়ে ফেলতে লাগলো। সত্যিই তো, আর ক'দিনই বা আছে সে! সময় যে শেষ...
"আচ্ছা..." সানজুর কথায় শৌখিনের ভাবনায় ছেদ পড়লো। সে সানজুর দিকে তাকালো।
"আপনি যদি এখান থেকে চলে যান, তবে কি আমাদের ভুলে যাবেন? আমাকেও ভুলে যাবেন?"
শৌখিন সানজুর হাত থেকে প্লেট দু'টো নিলো। সানজু একটু চমকে গেল। শৌখিন সানজুর দিকে কোমল দৃষ্টি মেলে বললো,
"না, ভুলবো না। কখনও ভুলবো না আপনাদের এবং আপনাকে। সহজে আমি কিছুই ভুলি না। যখন প্রথম আমি পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম, তখন আমি ছিলাম নিতান্তই একটি শিশু। বৃষ্টির মাঝে রাস্তার পাশে বেঞ্চির উপর একটা দম্পতি খুঁজে পেয়েছিল আমায়। তারা প্রথমে অবাক হয়েছিল। কারণ তখন ছিল প্রবল বৃষ্টি, সাথে দমকা হাওয়া, ওই বৃষ্টির মাঝে এত ভেজা সত্ত্বেও আমি কাঁদিনি। এমনকি আমার চেহারা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এমন অবস্থায় একটা বাচ্চা স্বাভাবিক থাকে কী করে? যেখানে তার জীবনেরও ঝুঁকি থাকার কথা!"
শৌখিন একটু থামলো। তারপর আবার বললো,
"সেই দম্পতির সাথে বৃষ্টির মৌসুমটা খুব ভালোই কেটেছিল! এবং সেই দুটি মুখ আমার এখনও মনে আছে। তাদের সাথে কাটানো সময় গুলোও স্মৃতি বদ্ধ আমার। সুতরাং, আপনাদের এবং আপনাকে ভুলে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। মায়াবী চেহারা যে সহজে ভোলা যায় না।" শেষের কথাটা সানজুকে উদ্দেশ্য করে বললো। কিন্তু সানজু তা বুঝলো না। সে বললো,
"যখন প্রথম পৃথিবীতে এসেছিলেন তখন আপনার বয়স কত ছিল?"
শৌখিন একটু ভেবে বললো,
"আমি যেই দম্পতির কাছে ছিলাম তারা অনুমান করেছিলেন আমার বয়স দুই কি তিন মাস!"
সানজুর ওষ্ঠ্যদ্বয় নিজ শক্তিতে আলাদা হয়ে গেল।
"কীহ? দুই তিন মাস? বলেন কী? অত ছোট থাকতে এত কিছু বুঝেছেন কীভাবে? আর ওই বয়সে কাউকে দেখলে কি তার চেহারা মনে রাখা আদৌ সম্ভব?"
সানজুর কণ্ঠে বিস্ময় উপচে পড়লো।
শৌখিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
"সম্ভব। আমি সকলের থেকে ভিন্ন।"
কথাটা বলতে বলতে শৌখিন বেরিয়ে গেল।
সানজুর এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু সে জানে শৌখিনের কথা সত্যি।
__________
মন্টু বারান্দায় বসে আছে। তার ঠিক সামনে শৌখিনও বসা। মন্টু বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে বসে আছে। মনে ক্ষোভ বিরাজ করেছে তার। এটা কী করে করতে পারলো তার ঘরের লোক? সে না বলা সত্ত্বেও কী করে আগামী মাসে তার বিয়ে ঠিক করতে পারলো তারা? পাত্রীর সাথে সামনা সামনি দেখা, কথা ছাড়াই বিয়ে দিতে চাইছে! এটা কোন ধরণের কথা হলো?
"ভাই!" মন্টুকে অনেকক্ষণ ধরে গোমড়া মুখে ভেজা কণ্ঠে ডাকলো শৌখিন।
কিন্তু মন্টু নিরুত্তর।
শৌখিন আবার ডাকলো,
"ভাই..."
এবার মন্টু কথা বলে উঠলো,
"ভূত ভায়া আপনিই বলেন, এটা কোন ধরণের কথা হলো! যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি তার সাথে কি আমার দেখা করা অথবা কথা বলার অধিকার নেই? যাকে বিয়ে করবো তার সাথে কথা বলে, সব দেখে শুনেই তো বিয়ে করা উচিত, না কি? কিন্তু দেখেন আমার ঘরের লোক কী পরিমাণ নিষ্ঠুরতা করছে! তারা বিয়ের দিন ছাড়া পাত্রীর সাথে আমাকে দেখাও করতে দেবে না, কথাও বলতে দেবে না!"
"কী আর করবেন, যেটা বলছে সেটাই মেনে চলুন। এবার আর কোনো ঝামেলা করবেন না দয়া করে। সবাই খুব খুশি এই বিয়ে দুটো নিয়ে।"
"ভূত ভাই আপনিও! শেষ পর্যন্ত আপনিও বললেন আমি ঝামেলা করি। আরে আমি তো ঝামেলা করি না। আমি তো আমার বাড়ির লোকদের আসল জিনিসটা ধরিয়ে দিই।"
"ওই যাই হোক, এবার আর তা করবেন না। এটা আমার অনুরোধ। শেষ অনুরোধ!"
সানজু সদর দরজার কাছ থেকে সরে পড়লো। তার শ্বাস যেন থেমে থেমে চালিত হচ্ছে। শৌখিনের 'শেষ অনুরোধ' কথাটার মর্ম মন্টু না বুঝলেও, সে বুঝলো। শেষ অনুরোধ মানে হলো, শৌখিন খুব শীঘ্রই চলে যাবে!
সানজু আবার উঁকি দিয়ে তাকালো বারান্দায়। তার ইচ্ছে করছে লোকটাকে জনম, জনম রেখে দেয় এই ঘরে! কিন্তু আদৌ কি আর কয়েকটা দিনও ধরে রাখতে পারবে লোকটাকে?
"আপু!"
কারো ডাকে সানজু নিজের খেয়ালে ফিরলো।
চাঁদনী এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
"এখানে একা একা চোরের মতো দাঁড়িয়ে কী করছিস?"
চাঁদনী সানজুর কাছে এসে দরজা দিয়ে বারান্দায় তাকালো। মন্টু আর শৌখিনকে দেখতে পেল বসা। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এদিকে সানজু আর চাঁদনী যে দাঁড়িয়ে আছে তা টের পেল না তারা। চাঁদনী সানজুর দিকে ফিরে তাকালো। চাঁদনীকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না সানজু। চাঁদনীর এক হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। চাঁদনী এমন কাণ্ডে যারপরনাই অবাক! সেই সাথে তার হৃদপিণ্ডও আঁতকে উঠলো। তার মনে হচ্ছে যেন ক্ষুব্ধ মৃত আত্মা তার হাত চেপে ধরেছে। সানজু কোনো কথাবার্তা না বলে চাঁদনীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? সকল ঘর অতিক্রম করে, সিঁড়ি...
সিঁড়ি? সিঁড়ি দিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ছাদে?
সানজু চাঁদনীকে ছাদে নিয়ে এসে হাত ছেড়ে দিলো। চাঁদনী সানজুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েই বলে উঠলো,
"পাগল হয়ে গেছিস তুই? ভূতের মতো আচরণ করলি কেন? ভূতে ধরেছে তোকে? ছাদে নিয়ে এলি কেন? ছাদ থেকে ফেলে দিবি বলে?"
সানজু ধপ করে বসে পড়লো ছাদের উপর। চাঁদনী আরও দ্বিগুন অবাক! কী, হলো কী তার বোনের? সত্যি সত্যিই পাগল টাগল হয়ে যায়নি তো আবার? হায় আল্লাহ!
চাঁদনী শংকিত চোখে তাকিয়ে রইল সানজুর দিকে।
সানজু কিছুক্ষণ দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। তারপর এক সময় চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
"সত্যিই কি আমি ভূতের মতো আচরণ করেছি?"
"তা নয় তো কী? আমি তো ভয়ে আধ মরা গেছি। আর একটু হলেই তো আমি হাঁক পেরে বাড়ির লোকজনদের ডাকতাম! উহ, কী ভয়টাই না আমি পেয়েছি।"
সানজু কী বলবে ভেবে পেল না। হঠাৎ ওরকম কেন করেছিল? নিজেই বুঝতে পারছে না।
"চাঁদনী রে..."
চাঁদনীকে কোমল গলায় ডাকলো।
"বল।"
"আমার একটা হেল্প করবি?"
"কী হেল্প?"
"একটা বিষয়ের সমাধান খুঁজে দিবি।"
"কী বিষয়ের?"
"তোকে একটা গল্প বলি শোন। এটা কোনো বাস্তব ঘটনা নয় কিন্তু। এটা কেবলই গল্প। সুতরাং, বাস্তব ভাববি না। ঠিক আছে?"
চাঁদনী কিছু বললো না।
সানজুই আবার বলা শুরু করলো,
"আমার ক্লাসমেট রিমঝিম আছে না, ওর কাছ থেকে একটা বই আনছিলাম। বইটা রূপকথার গল্পের ছিল। তো সেটার ভিতর আমার একটা প্রিয় গল্প হলো, 'তার ফিরে যাওয়া'। কিন্তু সমস্যা হলো গল্পটার কোনো সমাধান দেওয়া ছিল না! এখন আমি ভাবছি যে সমাধান টা কী হতে পারে? কিন্তু কিছু মাথায় আসছে না। তাই তোর সাহায্য চাচ্ছি। আচ্ছা, তোকে আগে গল্পটা বলি শোন।
সেটা ছিল একটা রাজ প্রাসাদ। হঠাৎ করে সেই রাজ প্রাসাদে একটা ছেলের আগমন ঘটে। ছেলেটা আকাশের বুক চিরে জমিনে পড়ে..."
"আকাশের বুক চিরে?"
বিস্মিত কণ্ঠে বললো চাঁদনী।
"হুম, আকাশের বুক চিরে। তো প্রথমে ছেলেটাকে সবাই পরী ভাবে। যেহেতু সে আকাশ থেকে পড়েছে, দেখতে ভালো, সেহেতু সবাই ভাবে সে একজন পরী। কিন্তু জ্ঞানী রাজা সবার ভুল ভাঙান। সে ছেলেটাকে মানুষ বলে দাবি করেন। এবং রাজ্যের লোক সেটা মেনে নেয়।"
"তারপর?"
"তারপর আর কী! ছেলেটা নিজের স্মৃতি মনে করতে পারে না। কোত্থেকে এসেছে, কী নাম কিছুই না। রাজা তো আর একটা স্মৃতি ভোলা ছেলেকে পাঠিয়ে দিতে পারেন না নিজের প্রাসাদ থেকে। তাই তিনি ছেলেটিকে নিজের প্রাসাদে স্থান দিলেন। কিন্তু রাজার মেয়ে রাজকুমারী ছেলেটাকে দেখতে পারতো না। তার অসহ্য লাগতো। কিন্তু যত দিন যেতে লাগলো, ছেলেটা প্রাসাদের সবার সঙ্গে একদম আপন মানুষের মতো মিশে যেতে লাগলো। এমনকি রাজকুমারীর নিজেরও আর খারাপ লাগতো না ছেলেটাকে। অবশেষে রাজকুমারী পছন্দই করে বসে সেই ছেলেটাকে। কিন্তু পরে একটা দুঃখ জনক ঘটনা জানতে পারে..."
"কী দুঃখ জনক ঘটনা?"
"সে সেই ছেলেটার মুখ থেকে শোনে যে, ছেলেটা না কি আসলেই একজন পরী!"
"কী? সত্যিই পরী ছিল? ছেলে পরীও হয়?" উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেল চাঁদনীর গলায়।
"হুম। ছেলেটা রাজকুমারীকে বলে, সে শুধু অল্প কিছু দিনের জন্য পৃথিবীতে এসেছে। একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা নিয়ে এসেছে। সেই সময় ফুরিয়ে গেলেই তাকে আবার পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। সে না চাইলেও যেতে হবে। এটাই তার ভাগ্য। কিন্তু রাজকুমারী তা মানতে নারাজ। সে কিছুতেই চায় না যে ছেলেটা চলে যাক। তাই সে ছেলেটাকে এই পৃথিবীতেই রাখার জন্য ইচ্ছা পোষণ করে। কিন্তু কীভাবে রাখবে সে? কী করলে রাখতে পারবে? রাজকুমারী ভাবতে থাকে..."
"তো, রাজকুমারী রাখতে পেরেছিল ছেলেটিকে?"
"আরে, সেটাই তো আমি জানি না। গল্প তো ওখান থেকেই শেষ হয়ে যায়।"
"কোন খান থেকে? ওই যে রাজকুমারী ভাবতে থাকে সেই খান থেকে?"
সানজু মাথা নাড়ায়।
"এখন তুই-ই বল, যে গল্পটা আমি এত আগ্রহ নিয়ে পড়লাম, আর সেটার শেষে কী হলো সেটাই আমি জানতে পারব না? ঠিক কী হয়েছিল? সত্যিই কী ছেলেটি চলে গিয়েছিল? রাজকুমারী কী চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি? আর যদি থামাতেও পারে, তাহলে কী করে থামালো? কী করে সেই ছেলেটাকে থামালো রাজকুমারী? তোর কী মনে হয়? কী করেছে রাজকুমারী?"
চাঁদনী একটু ভাবতে লাগলো গল্পটা নিয়ে। সে স্বাভাবিক একটা রূপকথার গল্প হিসেবেই নিলো সানজুর কথা গুলো। কিন্তু সানজু যে শৌখিনের ব্যাপারটাই এই গল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুললো, সেটা চাঁদনী ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারলো না।
চাঁদনী দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললো,
"আমার মনে হয় রাজকুমারী আটকাতে পারেনি ছেলেটাকে।"
সানজুর মুখ গোমড়া হয়ে গেল। সে চাঁদনীর কথায় অসন্তুষ্ট হলো। কপাল জোড়া কুঁচকে বললো,
"কেন? তোর এমন মনে হয় কেন?"
"কারণ ছেলেটা তো বলেই ছিল, সে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পৃথিবীতে এসেছে, সময়টা শেষ হয়ে গেলেই তাকে ফিরে যেতে হবে। এটাই তার ভাগ্য। তো রাজকুমারী কী-ই বা আর করতে পারবে ঐটুকুনি সময়ের মধ্যে? আসলে সে কিছুই করতে পারেনি। ছেলেটাকে চলেই যেতে হয়েছিল। আমার মনে হয় গল্পটার দুঃখজনক সমাপ্তি..."
"মানি না।" চাঁদনীর কথা শুনে গর্জে বলে উঠলো সানজু।
"কী মানিস না?"
"ছেলেটা কিছুতেই চলে যায়নি। আমি কিছুতেই চলে যেতে দেবো না ছেলেটাকে..."
"তুই যেতে দিবি না মানে? গল্পটা লেখকই যেখানে এরকম লিখেছে, সেখানে তুই কী করবি? তোর তো কিছু করার নেই।"
"করবো। অনেক কিছু করবো। দরকার পড়লে আমি এর সিক্যুয়েল লেখা শুরু করবো। যেখানে ছেলেটাকে আমি এই পৃথিবীতে রেখেই সুখে শান্তিতে বসবাস করাবো রাজকুমারীর সাথে।"
কথা গুলো বলে সানজু বসা থেকে উঠে গজগজ করে চলে গেল। ছাদ থেকে নেমে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় পথে কারো সাথে ধাক্কা লাগলো। কিন্তু সানজু তা উপেক্ষা করেই হেঁটে যাচ্ছিল। এমনকি খেয়ালও করলো না কার সাথে ধাক্কা লাগলো।
কতক হেঁটেই থামলো সানজু। পিছন ফিরে তাকালো। শৌখিন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে সানজুর দিকে। সানজু আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দ্রুত পা ফেলে শৌখিনের কাছে এলো। শৌখিনের একদম কাছে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
"কোত্থাও যাবেন না আপনি! যদি যান তবে খবর আছে।"
কথাটা বলেই সানজু আবার হনহন করতে করতে নিজের রুমে চলে গেল।
শৌখিন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শূন্য পথে।
আষাঢ়ে দেখা হবে পর্ব: ১৯ (শেষ পর্ব) (Bangla golpo ashare dekha hobe )
লেখা: ইফরাত মিলি
বাড়ির কোথাও শৌখিন নেই। সানজু সকাল বেলা উঠেই শৌখিনের ঘরে উঁকি দিয়েছিল, কিন্তু শৌখিনকে দেখতে পায়নি রুমে। রুমে না পেয়ে কদম তলা, ছাদ, পুকুর পাড়, কল পাড়, আম তলা, বাড়ির আশপাশ, মন্টু কাকার রুম, সব জায়গায় খুঁজেছে, কিন্তু দেখা পায়নি শৌখিনের। সানজুর বুক ঢিপঢিপ করছে। ভয়ের একটা স্রোত ক্রমশ আরও গভীরে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।
কোথায় গেল লোকটা? মন্টু কাকার সাথে যে বাড়ির বাইরে যাবে তাও তো না। মন্টু কাকা তো এখনও ঘুম থেকেই ওঠেনি। তাহলে? কোথায় গেল সে? তবে কি সত্যিই...
সানজু আর ভাবতে পারলো না। অস্থিরতা কেবল বেড়েই চলছে। কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না সে। কখনও এদিক ছুটছে, তো কখনও ওদিক। না, না কিছুতেই লোকটা এভাবে চলে যেতে পারে না। লোকটাকে কখনোই এভাবে চলে যেতে দেবে না সে।
কিন্তু কী করে আটকাবে তাকে? কোথায় গেল লোকটা?
সানজু কদম তলা থেকে অস্থির পা ফেলে ঘরে ঢুকতেই চাঁদনীর সাথে দেখা হলো।
চাঁদনী সানজুকে দেখে অবাক! এ কী অবস্থা সানজুর!
সানজুর কপাল থেকে ঘাম বেয়ে পড়ছে। রাতে চুলে যে বেণী করেছিল, সেটা এখনও সেরকমই, উস্কোখুস্কো অবস্থায় আছে। চোখের নিচে কেমন কালো দাগ পড়ে গেছে। চোখ, মুখ ফোলা ফোলা লাগছে।
চাঁদনী ভীত গলায় বলে উঠলো,
"আপু, এ কী অবস্থা তোর? জ্বর টর এসেছে না কি?"
সানজু অস্থির ভাবেই দুই পাশে মাথা নেড়ে বললো,
"না, না ওসব জ্বর টর আসেনি আমার। তুই..."
চাঁদনী সানজুর কথা শেষ করতে না দিয়ে বললো,
"তাহলে? তাহলে এই অবস্থা কেন? ও বুঝতে পেরেছি। ওই রূপকথার গল্পটা নিয়ে ভেবেছিস সারারাত ধরে, তাই না? আরে, ওটা তো সাধারণ গল্প মাত্র, ওটা নিয়ে এত ভাবাভাবির কী আছে? একটা গল্প পড়ে সেই গল্পের রেশ সারাজীবন ধরে বসে থাকবি না কি?"
সানজু কথা প্যাঁচালো না, সোজাসুজি চাঁদনীকে প্রশ্ন করলো,
"তুই শৌখিন লোকটাকে দেখেছিস?"
চাঁদনী অবাক হয়ে বললো,
"শৌখিন? এখানে তার কথা উঠলো কেন? তোর কী হয়েছে বল তো? ওনাকে নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন? আবার ওনার মতো আষাঢ় নিয়েও কথা বলছিস! ব্যাপার কী?"
"তুই দেখেছিস ওনাকে?"
সানজু চাঁদনীর কথায় অতিষ্ট হয়ে জোর গলায় আবার প্রশ্ন করলো।
চাঁদনীও কঠিন গলায় উত্তর দিলো,
"হ্যাঁ, দেখেছি। ওনাকে না দেখার কী আছে?"
সানজু বিস্মিত হলো। দেখেছে মানে? যাকে সে এত খুঁজেও পেল না, তাকে কোথায় দেখেছে চাঁদনী?
সানজু উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"কোথায় দেখেছিস?"
"দাদির রুমে।"
চাঁদনী কথাটা বলতে না বলতেই সানজু ছুটে চলে গেল। চাঁদনী আরেক দফা অবাক হলো! কী হলো কী সানজুর?
সানজু ছুটে এলো পারভেনু বিবির রুমের সামনে। ভেজানো দরজাটা দ্রুত দুই হাতে ধাক্কা দিয়ে সশব্দে খুলে ফেললো সে।
পারভেনু বিবি ভয় পেয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। শৌখিন চকিতে তাকালো দরজার দিকে।
সানজু দাঁড়ানো দরজায়। তার উষ্ণ ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে দ্রুত গতিতে। শৌখিনকে দেখে এতক্ষণে একটু শান্তি অনুভব করলো সে। সানজুর ঠোঁটে অজান্তেই একটু হাসিরা রেখা টেনে দিলো।
পারভেনু বিবি বলে উঠলেন,
"আরে ওই মাইয়া, ওই ভাবে কেউ দরজা খোলে? ঝড়ের লাহান দরজা খুইলা তো আমার আর শোকেনের গল্পর আসরডাই ভাইঙ্গা দিলি। কোনহান থেইকা আইলি তুই? এতদিন পোলাডারে খুঁইজাও পাইলাম না আমি, আর আইজকা পোলাডা নিজে আইছে আমার দ্বারে। আর তুই... কোনহান থেইকা আইলি তুই?"
পারভেনু বিবির কোনো কথা সানজুর কানে ঢুকলো না। সে শৌখিনের দিকে তাকিয়ে থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, দরজাটা আবার টেনে বন্ধ করে দিলো। দুই চোখ বন্ধ করে মনের ভয়কে উপশম করলো। উত্তেজনায় বাড়ির সব জায়গা খুঁজে দেখলেও, ঘরের রুম গুলো খুঁজে দেখা হয়নি তার।
সানজুর মনের শান্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। তার মনের আকাশ চিন্তার কালো ছায়া আবার গ্রাস করে ফেললো। শৌখিনকে খুঁজে না পাওয়ার জন্য তার বেশি ভয়ের কারণ ছিল, আজকে আষাঢ়ের শেষ দিন! কী হবে আজকে? আজকের দিনটা শেষ সাথে সাথে কি শৌখিনও নিঃশেষ হয়ে যাবে? কথাটা মনে হতেই সানজুর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠলো!
_____________
বাইরে তুমুল বৃষ্টি। সাথে ঝড়ো হাওয়াও বইছে। চাঁদনীর মনে হলো আজকে স্কুলে না গিয়ে ঠিক কাজই করেছে তারা। চাঁদনীর মনে খুশি খুশি লাগছে।
সবটাই হয়েছে আসলে সানজুর জন্য।
সানজু শৌখিনকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে চায় না। লোকটা কখন কোথায় চলে যায় তার ঠিক নেই। তাই সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখবে তাকে। সুতরাং স্কুলে তো যাওয়া যাবে না। তাই সে মাকে মিথ্যা কথা বলেছে। মিথ্যাটা হলো, ওই যে সানজু পায়ে ব্যথা পেয়েছিল, সেই ব্যথা না কি তার পায়ে আবার শুরু হয়েছে। সকাল বেলা কল পাড় থেকে আসার সময়, পা পিছলে পড়ে যাওয়ার পর থেকে পায়ে আবার ব্যথা করছে সেই আগের মতো। হেলেনার সামনে সানজু একটু খুঁড়িয়ে হাঁটার অভিনয় করেছিল, ব্যস তাতেই কেস সলভ। কারণ, সানজু ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো স্কুল কামাই দেয়নি। সুতরাং সানজুর কথা মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এদিকে সানজু স্কুলে যাবে না শুনে চাঁদনীও বায়না ধরে বসে।
অনেক করে বলার পর শেষমেশ মা কে মানাতে পেরেছে।
চাঁদনী নিজের স্কুলে না যাওয়ার কাহিনী মনে করে হেসে উঠলো।
"ওভাবে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হাসছেন কেন? বৃষ্টিও কি হাসির কারণ হয়?" সদর দরজায় দাঁড়িয়ে বললো শৌখিন।
চাঁদনী একবার তাকালো শৌখিনের দিকে। বললো,
"জি না, আমি বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হাসছিলাম না। আমি একটা কথা মনে করে হাসছি।"
"আচ্ছা?" শৌখিন এগিয়ে আসতে আসতে বললো। বেঞ্চির এক কোণে বসে বললো,
"কী কথা মনে করে হাসলেন?"
"আপনাকে বলবো কেন?"
"বলবেন না?"
"না।"
শৌখিন মনে মনে কী যেন ভাবলো।
চাঁদনী প্রশ্ন করলো,
"কী ভাবছেন?"
শৌখিন চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
"আপনার হাতে বানানো আচার খাওয়াতে পারেন আমায়?"
"আচার?"
"হুম।"
"হঠাৎ করে আচারের কথা মনে পড়লো কেন?"
শৌখিন বাইরের দিকে তাকালো। দূরের জিনিস কেমন ধোঁয়াশা মাখা দেখাচ্ছে। বৃষ্টির পানি ছিটকে আসছে বারান্দায়। শৌখিনের পা বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছে। শৌখিন বাইরে দৃষ্টি রেখেই বললো,
"যদি আপনার হাতের আচার আর খাওয়ার সুযোগ না পাই সেজন্য।"
"কী বললেন?"
শৌখিন চাঁদনীর দিকে তাকালো। হেসে বললো,
"মিস করছি আপনার হাতের আচার।"
"ঠিক আছে। আপনি বসুন, আমি আনছি।" চাঁদনী মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ালো।
সানজু কান পেতে চাঁদনী আর শৌখিনের কথা শোনার চেষ্টা করছে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। সানজু হলরুমে বসা। অনেকক্ষণ ধরেই এখানে বসে আছে। শৌখিন কোথায় যাচ্ছে, কী করছে এখান থেকে ভালো করে দেখা যায়।
হঠাৎ চাঁদনীর আগমনে সানজু সটান হয়ে বসলো। চাঁদনী একবার সানজুকে দেখে ভিতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর দু'টো আচারের বয়াম নিয়ে ফিরলো।
সানজু আড় চোখে দেখলো চাঁদনীকে। আচার নিয়ে ছুটছে কেন চাঁদনী?
চাঁদনী বারান্দায় চলে এলো। বেঞ্চিতে বসে, শৌখিনের হাতে একটা পিরিচ দিলো। তারপর একটা বয়ামের মুখ খুলে আচার বের করে পিরিচে রাখলো। শৌখিন অবাক হয়ে বললো,
"এত গুলো দিলেন কেন?"
"কেন? খেতে পারবেন না?"
"পারব, যদি ভাগাভাগি করে খান তবে।"
চাঁদনী হেসে পিরিচ থেকে আচার নিয়ে মুখে পুরলো।
_____________
সানজু হলরুমে সোফার উপর শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। এখানে বসে শৌখিনের উপর নজর রাখতে রাখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা সে নিজেও জানে না। হলরুমের পুরোনো দিনের ঘড়িটা শব্দ করে জানান দিলো দুপুর বারোটা বাজে। বাইরে আগের মতোই ঝড় বইছে। সানজুর কানে দূর থেকে ভেসে আসছে কারো গলা,
"এই আপু।"
সেই সাথে গায়ে কারো হাতের ঠেলাও অনুভব করতে পারছে। কিন্তু চোখ যে খুলতে ইচ্ছা করছে না।
চাঁদনী সানজুকে চোখ খুলতে না দেখে জোরে ঠেলা দিয়ে, চেচিয়ে বলে উঠলো,
"আপু, ওঠ।"
সানজু চাঁদনীর বিকট কণ্ঠের আওয়াজে ধরফরিয়ে উঠে বসলো। যখন সব কিছু খেয়ালে এলো তখন, এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো উত্তেজিত ভাবে। কোথায় গেল লোকটা? বারান্দায়ই তো বসা ছিল। কিন্তু এখন তো সদর দরজা বন্ধ। কোথায় গেল? কী করে বেখেয়ালে ঘুমিয়ে যেতে পারে সে। যেখানে এক মুহূর্তের জন্য লোকটাকে চোখের আড়াল করা বিপদজনক, সেখানে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল কে জানে!
চাঁদনী সানজুকে বারবার এদিক ওদিক তাকাতে দেখে বললো,
"কী খুঁজিস এদিক ওদিক?"
"তাকে..." এদিক ওদিক চোখ বুলাতে বুলাতে উত্তর দিলো সানজু।
"কাকে?"
সানজু চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে বললো,
"শৌখিন লোকটাকে দেখছি না যে। কোথায় উনি?"
"আবার সে! তুই এত শৌখিন, শৌখিন করছিস কেন? ওনাকে তো স্বাভাবিকই দেখি, তাহলে তুই এত অস্বাভাবিক আচরণ করছিস কেন? উনি কি সারাদিন তোর চোখের সামনে বসে থাকবে? ওনার কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? উনি মন্টু কাকার রুমে আছে। আচ্ছা শোন, তোকে একটা খুশির খবর দিই।"
"খুশির খবর?"
"হুম, খুশির খবর। খুশির খবরটা হলো, আব্বাস ভাই বিয়ে করেছে!" উল্লাসিত কণ্ঠে বললো চাঁদনী।
সানজুর চোখ বিস্ময়ে বড়ো হয়ে গেল।
"সত্যি? আব্বাস ভাই সত্যিই বিয়ে করেছে?"
"হুম, আব্বার কাছে ফোন দিয়েছিল। আমাদেরকে না কি সপরিবারে বউ দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে।"
অন্য সময় হলে সানজু এই খবর শুনে হয়তো খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠতো। আপদ নিজ থেকে বিদায় হলে কে না খুশি হয়। কিন্তু সে এখন এই খুশিটা উপভোগ করতে পারছে না। শুধুই শৌখিনের জন্য। শৌখিনের চিন্তায় কেন যেন সকল খুশি বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
চাঁদনী হঠাৎ নিজের হাসি মাখা মুখকে চিন্তিত বানিয়ে বললো,
"আচ্ছা আপু, একটা বিষয় বুঝতে পারছি না। আব্বাস ভাই তো তোকে বিয়ে করার জন্য পাগল ছিল, তাহলে হঠাৎ করে অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেললো কেন? তাও আবার হুট করে। আমি তো ভাবছিলাম তোর বিয়ের সময় সে খুব ঝামেলা করবে।"
সানজু ঠিক কী উত্তর দেবে? কী উত্তর দেওয়া উচিত? ভাবতে ভাবতে বললো,
"হয়তো ওনার আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছা শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি তো দেখতে আর অতটা সুন্দরী নই। যে মেয়েকে উনি বিয়ে করেছে সে মেয়ে নিশ্চয়ই অনেক রূপবতী। আর তার মতো মানুষের কি আর মতি গতির কোনো ঠিক আছে।"
"হ্যাঁ সেটা হতে পারে। কিন্তু জানিস, উনি যে মেয়েটাকে বিয়ে করেছে সে মেয়েটা না কি কয়েক মাস আগে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল। পরে আবার ডিভোর্স দিয়ে কয়েক দিন আগে চলে এসেছে।"
"তাই না কি? ভালো তো।"
"আসলেই আব্বাস ভাইর মতি গতির ঠিক নাই। সব অবিশ্বাস্য কাজ করে বেড়ায়। মোটেই বিশ্বাস করা যায় না তাকে।"
সানজু বিড়বিড় করে বললো,
"আর আমি যে একটা আস্ত অবিশ্বাস্য পাহাড়কে বিশ্বাস করে মাথায় নিয়ে বসে আছি, সেটার কী হবে?"
"অ্যাঁ? কী বলছিস?"
সানজু চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো,
"না কিছু না। লোকটা মন্টু কাকার রুমে আছে, তাই তো?"
চাঁদনীর মাথাটা ঘুরে উঠলো। আবার সেই লোক?
_____________
বৃষ্টি বাতাস সব থেমে গেছে। বাইরের অবস্থা করুণ। সানজুর বেশ কয়েকটা ফুলের গাছের অবস্থা প্রায় লণ্ডভণ্ড। সেগুলো নিয়ে সানজুর দুঃখ প্রকাশ করার সময় নেই। শৌখিনের দুঃখই এখন বড়ো দুঃখ। লোকটা কী আসলেই চলে যাবে? এই প্রশ্নটা মনে উঠলেই সানজুর চোখে জল এসে যায়! দিশেহারা লাগে।
মন্টু আর শৌখিন ঘর ছেড়ে বের হওয়া দিলেই সানজু দৌঁড়ে এসে বললো,
"মন্টু কাকা, কোথায় যাচ্ছ তোমরা?"
মন্টু বললো,
"প্রকৃতি দেখতে যাই রে সানজু। বৃষ্টির শেষে প্রকৃতি দেখতে যাওয়ার মধ্যেও একটা ভাব আছে।"
"কী দরকার? এই দুপুর বেলা প্রকৃতি দেখতে যাওয়ার কি কোনো দরকার আছে? তাছাড়া একটু পর গোসল সেরে সবাই ভাত খেতে বসবে। তুমি ভাত খাবে না?"
কথাটা মন্টু আর শৌখিনকে আটকানোর চেষ্টা করে বললো। সানজু চায় না শৌখিন চোখের আড়াল হয়ে যাক।
মন্টু সানজুর কথা শুনে নরম কোমল কণ্ঠে বললো,
"আহারে, আমার ভাতিজি আমায় নিয়ে কত চিন্তা করে! চিন্তা করিস না, আমরা এই যাব আর এই আসব।"
সানজু আর আটকাতে পারলো না তাদের। তারা ঘর থেকে নামলো। মন্টু কতক হেঁটে আবার দাঁড়ালো। বললো,
"ভূত ভায়া, আমার মনে হয়, আমাদের একটা ছাতা সঙ্গে নেওয়া উচিত। বৃষ্টি হলো বহুরূপী। কোন সময় আসবে, কোন সময় যাবে কিছুই বোঝা যায় না! দাঁড়ান আমি একটা ছাতা নিয়ে আসি।"
মন্টু ছাতা আনতে আবার ঘরে গেল। সানজু সুযোগ পেয়ে শৌখিনের কাছে এলো। শৌখিনের সাথে আজকে দিনের বেলা একটুও কথা হয়নি তার। সানজু এসেই বললো,
"সারাক্ষণ এদিক ওদিক এত ঘোরাঘুরি করেন কেন? কী ভাবছেন আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে আপনি চলে যাবেন? উঁহু, সেটা হবে না। আমি আজকে সারা দিন আপনাকে চোখে চোখে রাখবো। দেখবো আপনি আমার চোখের সামনে থেকে কীভাবে হাওয়া হয়ে যান!"
"আমি চলে গেলে কি আপনার কষ্ট হবে?"
শৌখিনের কথাটা সূক্ষ্ম তীরের মতো এসে সানজুর হৃদয়ে বিঁধলো। সানজু মনে মনে বললো,
"আপনি চলে গেলে শুধু আমার কষ্টই হবে না, কষ্ট যেখান থেকে নির্গত হয় সেই স্থানটাও নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমার হৃদয়টা মরে যাবে। প্লিজ আমাকে একা ফেলে রেখে চলে যাবেন না। আমার সাথে থেকে যান।"
কিন্তু মুখে বললো,
"দয়া করে চলে যাবেন না। থাকুন আমাদের সাথে।"
"যদি চলে যাওয়া, না যাওয়া নিজের হাতে থাকতো, তাহলে বাকিটা জীবন এখানেই থেকে যেতাম। আর যদি থাকতেই পারতাম, তাহলে কখনও আপনাকে আমার এই অবিশ্বাস্য জীবনের গল্প বলে কষ্ট দিতাম না।
কিন্তু চলে যেতে হবে বলেই আমার গল্প আপনাকে বলেছি। কারণ লোক মুখে শুনেছি, মানুষ যা নিয়ে কষ্ট পায় তা না কি সহজে ভুলে যায় না।"
সানজু ভীষণ কষ্ট অনুভব করলো। চোখ ফিরিয়ে নিলো শৌখিনের থেকে। এরই মধ্যে মন্টু ছাতা নিয়ে এসে পড়ল। তারপর দুজনে বেরিয়ে গেল বাড়ি ছেড়ে।
রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছে মন্টু, শৌখিন। রাস্তার দুই পাশে মাঠ। মাঠে এখন ধানের বীজ লাগানো। বীজের অনেক ক্ষতি হয়েছে ঝড়ের কারণে। রাস্তার ধারের গাছ থেকে কয়েকটা ডালও ভেঙ্গে পড়েছে দেখা যায়। রাস্তায় একটা মানুষও নেই। শূন্য রাস্তা। শৌখিন হাঁটতে হাঁটতে এক সময় নরম কণ্ঠে মন্টুকে ডাকলো,
"ভাই..."
মন্টু একটু সামনে হাঁটছিল, সে দাঁড়িয়ে গেল। পিছন ফিরতেই শৌখিন তাকে জড়িয়ে ধরলো। মন্টু আশ্চর্য হলো। হঠাৎ করে শৌখিনের এমন করার মানে বুঝতে পারলো না! শৌখিন মন্টুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
"একটি মুহূর্তের জন্যও আমি আপনাকে ভুলতে পারব না, ভাই। প্রতিটি মুহূর্তে আপনাকে মনে পড়বে আমার।"
মন্টুর কেন যেন হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল।
শৌখিন ছেড়ে দিলো মন্টুকে। মন্টু বললো,
"হঠাৎ এমন কথা বলছেন কেন, ভূত ভাই?"
শৌখিন নিজের অশ্রু চেপে বললো,
"আমি যদি আপনাদের ছেড়ে চলে যাই, তাহলে আপনি খুব কষ্ট পাবেন, তাই না?"
মন্টুর মুখ কালো আঁধারে ছেয়ে গেল। তার মনে হলো, শৌখিনের এই কথা খারাপ কিছুর আশঙ্কার বহিঃপ্রকাশ।
"এই কথা বলছেন কেন, ভূত ভায়া? আপনার কি আগের কথা সব মনে পড়ে গেছে? কোত্থেকে এসেছেন, বাড়ি ঘর কোথায় সেসব কি জানেন?"
শৌখিন মাথা নেড়ে বললো,
"না।"
মন্টু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। মুখের আধাঁর ভাবটা নিমিষেই কেটে গেল।
"ভূত ভায়া, আপনার তো কিছুই মনে নেই। আর আমি চাই ও না কখনো আপনার অতীত মনে পড়ুক। আপনি আমাদের সাথেই থেকে যাবেন। আমরাই আপনাকে আমাদের কাছে রাখবো। আপনি বাকিটা জীবন আমাদের সাথে থাকবেন। আপনাকে আমরা বিয়ে দেবো।"
"তাই? আপনারা বিয়ে দেবেন আমার?"
মন্টু খুশিতে আটখানা হওয়ার মতো করে বললো,
"হুম দেবো তো। আমাদের বাড়িতে এরপর থেকে কয়েকটা জোড়া বিয়ে হবে। ভাবতেই আমার বেশ খুশি লাগছে। আমার আর ঝন্টুর বিয়ের পর, আপনার আর সাব্বিবের জোড়া বিয়ে দেবো। তারপর সানজু আর চাঁদনীরও একই দিনে বিয়ে দেবো। কেমন হবে ব্যাপারটা? ভাবছি জোড়া বিয়ের ব্যাপারে আম্মা আর ভাইজানের সাথে আলোচনা করব।"
শৌখিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জীবন এত কষ্টদায়ক হতে পারে এখানে আসার আগে এক মিনিটের জন্যও টের পায়নি সে। সানজুরও কি এমন কষ্ট হয়?
______________
বিকেলে আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়া শুরু করেছে। পরিবেশ শীতল। শৌখিন ঘরের পিছনে রান্নাঘরে যাচ্ছে। এক সময় হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল শৌখিন। পিছন ফিরতেই সানজু থমকে দাঁড়িয়ে গেল। শৌখিনের থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে দাঁড়ানো সানজু। শৌখিন বললো,
"আমার পিছন পিছন আসছেন কেন?"
সানজু চার-পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়েই উত্তর দিলো,
"আমি তো বলেইছি যে, আমি আপনার উপর নজর রাখবো। সেটাই তো করছি।"
"তাই বলে পিছন পিছন হেঁটে? বাড়ির লোক দেখলে কী ভাববে?"
"বাড়ির লোক যা ভাবার তাই ভাবুক, আমার তা নিয়ে ভাবনা নেই। আমার ভাবনা শুধু আপনাকে নিয়ে। কোথায় যাচ্ছেন আপনি?"
"রান্না ঘরে যাচ্ছি।"
"তো আপনি একাই কি শুধু রান্না ঘরে যেতে পারেন? আমি পারি না?"
সানজু দ্রুত পায়ে শৌখিনকে অতিক্রম করে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল।
হেলেনা পিঠা বানাচ্ছেন। চালের গুঁড়া, কলা, নারিকেল, তালের গুড় দিয়ে বড়া পিঠা বানাচ্ছেন তিনি। এই পিঠা বাড়ির সবাই পছন্দ করে। বিশেষ করে সাবের সাহেব, পারভেনু বিবি আর ঝন্টু একটু বেশিই পছন্দ করে।
সাব্বিরও রান্নাঘরের এক পাশে চেয়ার পেতে বসে আছে মোবাইল নিয়ে। নোটপ্যাডের ভিতর কবিতা লেখায় ব্যস্ত সে। হঠাৎ সানজুর ভারী পায়ের আওয়াজে সাব্বিরের লেখায় ব্যাঘাত ঘটালো। সানজু রান্না ঘরে পা রেখেই নিজের নাটক শুরু করলো। খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে হেলেনার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
সাব্বির ব্যাপারটা বুঝলো না, হঠাৎ করে সানজুর পায়ে কী হলো? সাব্বির প্রশ্ন করলো,
"তোর পায়ে কী হয়েছে রে?"
হেলেনা বলে উঠলেন,
"কী হয়েছে সেটা তোমার জানতে হবে না। মেয়েটা স্কুলে গেল না পায়ে ব্যথার জন্য, সারা বাড়ি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, আর উনি এখন এসে জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে!"
সানজু মনে মনে হাসলো। কোথায় সে সারা বাড়ি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে? সে তো শুধু মায়ের সামনেই খুঁড়িয়ে হাঁটার অভিনয় করছে।
সাব্বির উৎকন্ঠা হয়ে বললো,
"তাই না কি? আবার কী হলো ওর পায়ে?"
এবার আর কেউ-ই কোনো উত্তর দিলো না সাব্বিরের কথায়। সানজু এগিয়ে আসলে হেলেনা একটা পিঁড়ি এগিয়ে দিলেন। সানজু পিঁড়িতে বসে, হাতে একটা গরম বড়া তুলে নিয়ে কয়েক বার ফু দিয়ে আবার ছেড়ে দিলো। এত গরম কি আর হাতে সয়? হেলেনা একটা হালকা গরম পিঠা বেছে সানজুর হাতে দিয়ে বললো,
"এইটা খা।"
সাব্বির বললো,
"বা রে, মেয়ে এসেছে আর অমনি তাকে পিঠা এগিয়ে দিচ্ছ? আর আমি যে সেই কতক্ষণ ধরে এখানে বসে আছি, কই আমাকে তো একটা পিঠা নিয়ে সাধলে না!"
এবারও কেউ কোনো জবাব দিলো না সাব্বিরের কথার। সাব্বির অপমান বোধ করলো। যাহ, আর কোনো কথাই বলবে না সে।
শৌখিনও এসে হাজির হলো রান্নাঘরে। হেলেনা একটা পিঁড়ি এগিয়ে দিতে বললো সানজুকে।
শৌখিন বসলো। হেলেনা শৌখিনকে পিঠা খেতে বললেন।
শৌখিন এক কামড় খেয়ে বললো,
"আপনার বানানো পিঠা খুব মজা হয়, আন্টি।"
হেলেনা তেলের ভিতরে গোলা দিতে দিতে বললেন,
"তাই বাবা?"
"হ্যাঁ। অপনার পিঠা অনেক মিস করবো আমি।"
সানজুর পিঠা খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মন আবার খারাপ হয়ে যেতে লাগলো। একটু সময়ের সে প্রায় মন খারাপি ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু এই লোকটা...
কেন তাকে এমন ভাবে কথা বলতে হবে? তার কথা বলার মাঝেও কেমন চলে যাওয়া, যাওয়া ভাব আছে! সানজু অর্ধ খাওয়া পিঠাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রান্নাঘর থেকে চলে যাওয়ার সময় সাব্বির চাপা স্বরে ডাক দিলো,
"সানজু!"
সানজু দাঁড়ালো। সাব্বির সানজুকে দরজার কাছে এনে ফিসফিসে গলায় বললো,
"কী হইছে রে তোর? খেয়াল করেছি, কয়েক দিন ধরে কেমন যেন হয়ে গেছিস। শরীরের যত্ন নেওয়া কি ছেড়ে দিয়েছিস? মুখের এই হাল কেন? ওই আব্বাসের জন্য এখনও মন খারাপ করে বসে আছিস? আরে ওর জন্য মন খারাপের কী আছে? ওরে এই বাড়ির কেউ পাত্তা দেয়? আব্বাসের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে। আর আমি তো কিঞ্চিৎ সাউন্ড পেলাম যে, আব্বাস না কি বিয়ের জন্য মেয়ে টেয়ে খুজঁতেছে।"
ভাইয়ের কথায় সানজুর ভিতরটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। মনে মনে বললো,
'ভাইয়ারে, আমার বেঁচে থাকাটাই কেমন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। শরীরের আর কী যত্ন নেবো? আমি ভালো নেই ভাইয়া, একদম ভালো নেই! আস্তে আস্তে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় কি না সেটাও জানি না!'
মুখে মিন মিন করে বললো,
"ভাইয়া, তার মেয়ে দেখার কিঞ্চিৎ সাউন্ড না, আমি তো বিয়ের ফুল সাউন্ডই পাইছি।"
"মানে?"
"আব্বাস ভাই তো বিয়ে করেছে। আমাদের সপরিবারে বউ দেখতে যাওয়ারও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কেন, তুই এসব জানিস না?"
"কই না তো!"
"ওহ। চাঁদনী আর মন্টু কাকার কাছ থেকে ভালো করে শুনে নিস।"
সানজু চলে গেল। সাব্বির লক্ষ্য করলো সানজু খুঁড়িয়ে হাঁটছে না। ব্যাপার কী? একটু আগেও তো খুঁড়িয়ে হাঁটছিল!
"ভাই, পিঠা খান।" সাব্বিরের দিকে পিঠা এগিয়ে দিয়ে বললো শৌখিন।
সাব্বির বললো,
"দেখলেন ভাই, আমার মা, আমার বোন কেউই আমাকে পিঠা নিয়ে সাধলো না। কিন্তু আপনি, আপনি ঠিকই আমাকে পিঠা খেতে বলছেন। একেই বলে মাঝে মাঝে আপনও পর হয়ে যায়, আবার পরও আপন হয়।"
হেলেনা বললেন,
"হ্যাঁ, হ্যাঁ আমরা তো আপন হয়েও পর। এখন কোনো পরের বাড়িতে গিয়ে আপন হয়ে থাক গিয়ে, হুহ্।"
শৌখিন হেলেনার কথা শুনে হেসে ফেললো। সানজু দূরে ঘরের ভিতর বসে খেয়াল করলো, শৌখিন হাসলে, শৌখিনকে দারুণ লাগে।
কেউ তো আর জানে না, ওই দারুণ হাসির লোকটা সানজুর ভীষণ প্রিয়!
____________
মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। সাবের সাহেব পুকুর ঘাট থেকে ওযু করে এসে নামাজ পড়লেন। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর যখন ঘর থেকে বের হবে বলে মনস্থির করলো, তখনই শৌখিন আসলো। সাবের সাহেব শৌখিনকে দেখে বললো,
"কী খবর তোমার?"
"ভালো।" তারপর একটু চুপ থেকে বললো,
"চলেন, দাবা খেলা যাক।"
সাবের সাহেবের মুখটি চকচক করে উঠলো। এমনিতে সে দাবা খেলার সঙ্গীই পান না। আজ যখন কেউ নিজ থেকে তার সঙ্গী হতে এসেছে তখন সে কি বসে থাকবে?
শৌখিন একটা পাটি বিছিয়ে দিলো মেঝের উপর। সাবের সাহেব দাবার কোড আর গুটি গুলো নিয়ে বসলেন। দীর্ঘ সময় ধরে দাবা খেলা চললো। এর মধ্যে হেলেনা তাদের জন্য, বড়া পিঠা আর চা'ও দিয়ে গেছেন। শৌখিন হেরে গেল খেলায়। সাবের সাহেবের মনে উল্লাস দেখা দিলো। আজ পর্যন্ত কারো সাথে দাবা খেলে হারেনি সে।
শৌখিন চলে যাওয়ার আগে সাবের সাহেবকে বললো,
"ধন্যবাদ আপনাকে। আপনিই আমাকে এই ঘরে জায়গা দিয়েছিলেন। যদি আপনি না চাইতেন তাহলে আমি এখানে থাকতে পারতাম না। আমি কিছু মনে করতে পারছি না জেনে আপনি আমাকে একটি দীর্ঘ সময় নিজের বাড়িতে স্থান দিয়েছেন। আমি সৌভাগ্যবান।"
"হঠাৎ করে এসব বলার কারণ কী? এমন ভাবে বলছো যেন মনে হচ্ছে আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে তুমি!"
শৌখিন হেসে বললো,
"বরাবরই বুদ্ধিমান আপনি। ভাবছি যদি সত্যি সত্যিই কোনো দিন আপনার বাড়ি ছেড়ে চলে যাই, তাহলে এই বাড়ির মানুষ গুলো ছাড়া থাকবো কী করে! কষ্ট হবে যে ভীষণ।"
সাবের সাহেব শৌখিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু বোঝার চেষ্টা করে বললেন,
"তোমার কথা বার্তা ভালো ঠেকছে না কিন্তু!"
শৌখিন হেসে ফেললো।
"সন্দেহ হচ্ছে আমায়?"
সাবের সাহেব দুই পাশে মাথা নেড়ে বললেন,
"না। তবে, অনেক দিন পর তোমায় আজ আবার রহস্যময় মনে হচ্ছে।"
শৌখিন বসা থেকে উঠতে উঠতে বললো,
"কিছু, কিছু জিনিস রহস্য থাকাই ভালো। যে রহস্যের কোনো মীমাংসা নেই, সে রহস্য প্রকাশ না করাই উত্তম। যাচ্ছি।"
শৌখিন সাবের সাহেবের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সাবের সাহেব শূন্য দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আর অনুভব করলেন, কোনো এক আপন জিনিস যেন হারিয়ে যাচ্ছে তার কাছ থেকে!
____________
সানজু অশান্ত মনে রুমের এ কোণা থেকে ও কোণা পায়চারি করছে। সারা গা ঘেমে নেয়ে একাকার। মনের ভিতর অশান্ত ছটফটানি। একটি বিষয়েই কেবল অস্থিরতা! সানজু চায় না যে কালকে আর ভোরের আলো ফুটুক। আজকের রাত এত দীর্ঘ হোক যে, রাতের এই দীর্ঘতায়ই শৌখিনের সাথে সারা জীবনটা কেটে যাক।
এখন গভীর রাত। সারা জমিদার বাড়ি ঘুমন্ত পুরীতে পরিণত হয়েছে। জেগে আছে কেবল সানজু। সানজুর অস্থিরতা বেড়েই চলছে ক্ষণে ক্ষণে। কেন যেন কান্না নিগড়ে আসছে ভিতর থেকে। না এমন করলে হবে না। সানজু হাত মুঠো করে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলো বুকে। না শান্ত হচ্ছে না মন। সানজু ফুঁপিয়ে কেঁদেই উঠলো। বসে পড়লো ফ্লোরের উপর। থেমে থেমে আরও জোরে কেঁদে উঠছে সানজু।
সানজু অশ্রু ভেজা নয়নে হাতের কাগজটার দিকে তাকালো। গলার কাছটা ব্যথা করছে। অসহ্যনীয় কষ্টে গলা থেকে জোরে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছে। কেন হচ্ছে এমন? কেন? সময় এখানে থমকে যেতে পারে না? থমকে যাক সময়! সবকিছু স্থির হয়ে যাক...
অনেক রাত হওয়ার পরেও যখন ঘুম আসছিল না, তখন সানজু উঠে ঘরের মাঝে হাঁটাহাঁটি করছিল। আর সে সময় টেবিলে একটা ভাজ করা কাগজ নজরে পড়ে সানজুর। বেয়াখালে আগে নজরে পড়েনি কাগজটি। কাগজটা দেখেই সানজুর হৃদয় কেঁপে ওঠে। মনে হয়েছিল, ওই কাগজ হাজারও কষ্টের কারণ হয়ে উঠতে পারে তার জন্য। ঠিক তাই হলো! কাগজে লেখা ছিল,
'ভোরের আবছা আলো আকাশে ফুঁটে ওঠার সাথে সাথেই দেখা করুন আমার সাথে। বাড়ির সামনের রাস্তায় অপেক্ষা করবো আপনার জন্য। ও আর একটা প্রশ্ন আপনার জন্য, শেষ বিদায়ের মুহূর্ত মিষ্টি হয় না কি তিক্ত?'
লেখাটা দেখেই সানজুর বুঝতে বাকি থাকে না কালকের দিনটা তার জন্য কতটা তিক্ত হতে চলেছে। কিন্তু মনে প্রাণে চেয়ে যাচ্ছে কালকের দিনটায় শৌখিনের নিয়তি বদলে যাক। বরাবর তার সাথে যা হয়ে আসছে, এইবার উল্টোটা হোক।
সানজু চোখের পানি মুছে নিজের রুম থেকে বের হয়ে, দ্রুত পায়ে শৌখিনের ঘরের দিকে ছুটলো। শৌখিনের রুমের দরজা বন্ধ। সানজু আস্তে করে দরজায় করাঘাত করলো। দরজা খুললো না। আবার করাঘাত করলো। একটু জোরেই করলো। হ্যাঁ, এবার খুললো দরজা। শৌখিনকে দেখেই সানজু উৎকণ্ঠা হয়ে বলে উঠলো,
"কী ব্যাপার, প্রথমে দরজা খুললেন না কেন?"
"আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একটু।"
"ও..."
সানজু শৌখিনের রুমে ঢুকে পড়ল। শৌখিন বললো,
"এত রাতে আমার রুমে এসেছেন কেন?"
সানজু হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো তিন টা বিশ বাজে। দেখে নিয়ে বললো,
"এত রাত কোথায়? মাত্র তিন টা বিশ বাজে।"
সানজু প্রতিটা মুহূর্তের হিসাব রাখছে তাই হাতে ঘড়ি পরে হাঁটছে।
"রাত তিন টা বিশ বেজেছে এটাকে আপনার মাত্র মনে হচ্ছে?"
"হোক মাত্র বা অমাত্র তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার আসার ছিল তাই আমি এসেছি।"
শৌখিন প্রশ্ন করলো,
"কেন এসেছেন?"
"আপনি কি থেকে যেতে পারেন না? সত্যিই পারেন না? কোনো উপায় কি নেই থাকার?" তীব্র প্রশ্নবিদ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইলো সানজু।
শৌখিন সোজা উত্তর দিলো,
"না।"
শৌখিনের কথায় হতাশ হলো সানজু।
"না কেন? কোনো না কোনো উপায় তো থাকাই উচিত। কারো জীবন এমন ভাবে চলতে পারে না।"
"কিন্তু আমার জীবন এভাবেই চলে।"
"কেন চলে?" সানজুর চোখে পানি চিকচিক করে উঠলো।
"আমি নামাজে প্রতি সিজদায় চাই যেন আপনি এখানে থাকতে পারেন। প্রতি মুহূর্তেই শুধু একটা প্রার্থনা করি যেন, আপনি আমাদের সাথে থাকতে পারেন। আমি..."
"আমায় চলে যেতেই হবে।"
"একটা উপায়ও নেই থাকার? হোক যতই কঠিন, একটাও কি নেই?"
"আমার জানা মতে নেই। কখনো তো কোথাও থেকে যাওয়ার কথা ভাবতাম না, তাই এই ব্যাপার নিয়ে কখনো ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়নি। নিয়তি যেভাবে টানছে, আমি ঠিক ওভাবেই ছুটছি।"
সানজু আর কিছু বললো না। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে নিজের কান্না থামালো। তারপর নিরাশ ভাবে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। দরজার কাছে আসতেই পিছনে শৌখিনের কোমল শান্ত কণ্ঠ শোনা গেল,
"আরও একটু সময় থাকতে পারেন আমার সাথে?"
শৌখিনের কণ্ঠ শোনার সাথে সাথে সানজুর পা দুটি যন্ত্রের মতো থেমে গেল।
সানজুর দুই চোখ থেকে নীরবে পানি গড়িয়ে পড়লো। সানজুর মন বিষাদের সুরে বলে উঠলো,
"আমি কি একটু সময়ের জন্য থাকতে চেয়েছি আপনার সাথে? থাকতে তো চেয়েছি জীবনের পুরো সময়। কিন্তু ভাগ্যই তো নির্মম, নিষ্ঠুর!"
সানজু কোনো প্রতিউত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
সারা রাত সানজু একটুও চোখের পাতা এক করতে পারলো না। প্রায় কেঁদে কেঁদেই পুরো রাত পার করলো। চোখের নিচের কালো দাগ আরও তীক্ষ্ণ দেখাচ্ছে এখন। বাইরে এখন বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। একটু পরই ফজরের আজান শোনা গেল। সানজু রুমের জানালা খুলে দিলো। বাইরে এখনও অন্ধকার। একটু আলো ফুটলেই বের হবে ঘর থেকে।
এটাই ছিল তবে নিয়তি? এত নিষ্ঠুর নিয়তিও কারো হয়? মানুষটাকে সত্যিই এভাবে হারিয়ে ফেলবে?
সানজু বড়ো করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার বাইরে অন্ধকারের মাঝে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে।
____________
সানজু মাথার উপর নীল রঙের ছাতাটা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে বাড়ির সামনের দিকে। প্রবেশদ্বার পেরোতেই ভোরের আবছা আলোয় শৌখিনকে দেখা গেল।
এই বৃষ্টির মাঝে এক গুচ্ছ কদম হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। এতক্ষণ সানজুর জন্যই অধীর অপেক্ষায় ছিল সে। অনেক আগে থেকেই এখানে দাঁড়িয়ে সে।
সানজু শৌখিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। সানজুর ইচ্ছে করলো ছাতাটা শৌখিনের মাথার উপর ধরতে, কিন্তু, কী কারণে যেন পারলো না!
কিন্তু শৌখিনই সানজুকে অবাক করে দিয়ে ছাতার নিচে এসে দাঁড়ালো। সানজু অবাক হয়ে তাকালো শৌখিনের দিকে। শৌখিনের চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সানজু এই প্রথম এত কাছ থেকে শৌখিনের মুখ দেখলো। আজকে আর এই মুখকে ধোঁয়াশা মাখা মনে হচ্ছে না, খুব সহজেই যেন এই মুখের ভাষা পড়ে ফেলা যায়।
শৌখিন হাতের কদম গুচ্ছ সানজুর হাতে দিতে দিতে বললো,
"অধিকার নিয়ে কদম রানির, কদম গাছ থেকে কদম ছিঁড়লাম। কদম রানির হাতে শূন্যতা মানায় না।"
সানজুর ভিতরটা কাঁদছে, কিন্তু বাইরে সে কাঁদলো না। বহু কষ্টে নিজেকে শক্ত রেখে দাঁড়িয়ে রইল। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল শৌখিনের দিকে। দুই চোখ লাল হয়ে আছে সানজুর। সানজুর মনে হলো কান্না চেপে রাখার মতো কঠিন কাজ পৃথিবীতে আর নেই।
শৌখিন কিছুক্ষণ সানজুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,
"বৃথা চেষ্টা করছেন কেন? যদি কান্না আসে তাহলে কেঁদে ফেলুন। কান্না চেপে রাখবেন না, তাতে কষ্ট বাড়ে।"
শৌখিনের কথা শুনে সানজু আর কান্না আটকে রাখতে পারলো না। দুই চোখ বেয়ে অজান্তেই কখন যেন পানি ঝরে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
"ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি আমি। কেন এত কষ্ট দেন আপনি?"
শৌখিন সানজুর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
"কাঁদলে অনেক বেশি সুন্দর লাগে আপনাকে। কিন্তু, আমি আপনাকে কাঁদাতে চাই না। তবুও দেখুন, আমি আপনাকে কাঁদাচ্ছি, আর আপনি কাঁদছেন!"
সানজু আর সহ্য করতে পারছে না এই অসহ্য কষ্ট। উহ, হৃদয় যে এভাবে ভাঙচুর হচ্ছে তা কি আর থামবে না?
শৌখিনের চোখ জ্বালা করছে। কান্না কতক্ষণই বা আর নিজের বশে রাখা যায়? শৌখিন তবুও কান্না আটকে রাখলো। বললো,
"জানেন, এই প্রথম আমি কোনো জায়গায় চিরকাল থেকে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম।"
শৌখিনের কথা শুনে সানজু তাকালো তার দিকে।
শৌখিন বলে যেতে লাগলো,
"কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছা যে পূরণ হয় না। মানুষের মনে অনেক অপূরণীয় ইচ্ছা জমে থাকে, যা কোনো দিন পূরণ হবে না জেনেও তারা তাদের ইচ্ছাকে সযত্নে আগলে রাখে। আমার ইচ্ছাটাও বোধহয় ওই কাতারে।" কথাটা বলতে গিয়ে শৌখিনের গলা অস্বাভাবিক রকমের কেঁপে উঠলো।
সানজু জোরে কেঁদে উঠলো। কী করবে? কী করা উচিত এখন? এই মানুষটা চলে গেলে কীভাবে থাকবে? সানজু কান্না মাখা কণ্ঠে অভিমানী সুরে বললো,
"নিষ্ঠুর আপনি, খুব নিষ্ঠুর! আপনার দেখা পেয়ে আমার ভাগ্যও নিষ্ঠুর হয়ে গেছে! যারা মানুষকে কাঁদিয়ে চলে যায় তারা খারাপ হয়। আপনি খারাপ লোক, বাজে লোক। কেন এত বাজে আপনি? একটু ভালো হলে কি খুব খারাপ হতো? আমার জন্য হলেও কি একটু ভালো হতে পারেন না? এত নির্দয় কেন আপনি?"
"যদি নির্দয়ই হতাম তাহলে আমার থেকে ভাগ্যবান আর কেউ হতো না। কিন্তু আমি নির্দয় নই। শেষ বিদায় যে এতটা করুন হতে পারে, নির্দয় হলে কি সেটা অনুভব করতে পারতাম? আমার হৃদয় আছে। একটি কষ্টময় হৃদয়।"
" প্লিজ যাবেন না আপনি। আপনি গেলে আমার কষ্ট হবে। আপনি তো নির্দয় নন, আপনার হৃদয় আছে, অনুভব করতে পারেন। তাহলে আমার কষ্ট কেন অনুভব করতে পারছেন না? দয়া করে আমায় একটু অনুভব করার চেষ্টা করুন।"
"আমি সব কিছু অনুভব করতে পারছি। আপনার কষ্ট গুলোও অনুভব করতে পারছি। কিন্তু আমি নিরুপায়!"
"আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি! আমি এইভাবে থাকতে পারব না।"
"আপনাকে ভালো রাখতে কী করতে পারি আমি?"
"শুধু থেকে যান।"
"সেটা সম্ভব নয়।"
সানজু এক পা এগিয়ে এসে বললো,
"কেন সম্ভব নয়? থাকতেই হবে আপনাকে। থাকুন আপনি।"
শৌখিন সানজুর চোখে চোখ রেখে বললো,
" সত্যিই চান আমি থেকে যাই?"
সানজু মাথা নাড়লো।
শৌখিন বললো,
"তাহলে অপেক্ষা করুন।"
সানজুর কান্না থেমে গেল। অবাক হয়ে বললো,
"অপেক্ষা?"
"কয়েকটা আষাঢ় অপেক্ষা করতে পারবেন আমার জন্য?"
"আষাঢ়?"
"হ্যাঁ, পারবেন কয়েকটা আষাঢ় অপেক্ষা করতে?"
সানজুর মন যেন বুঝে গেল শৌখিনের কথার মানে। সানজু শান্ত কণ্ঠে বললো,
"আপনার জন্য শুধু কয়েকটা আষাঢ় কেন? হাজারটা আষাঢ়ও অপেক্ষা করতে পারি আমি।"
শৌখিনের মন কোমলতায় ভরে গেল। সে বেরিয়ে এলো সানজুর ছাতার নিচ থেকে। আবারও বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁয়ে দিতে লাগলো তাকে। সানজুকে শেষবার দেখে নিয়ে একটু হাসলো শৌখিন। বললো,
"আবার কোনো এক আষাঢ়ে দেখা হবে।"
কথাটা বলেই শৌখিন হাঁটতে শুরু করলো। সানজু দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো শৌখিনকে পিছন থেকে। সানজু যেন শক্তিহীন হয়ে গেছে। শৌখিন চলে যাচ্ছে জেনেও কিছু করতে পারছে না সে। এমনকি একটা ডাক পর্যন্তও তার গলা থেকে বের হচ্ছে না। সে শক্তিহীন একটি বস্তুর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
ওদিকে শৌখিন হেঁটে যাচ্ছে। এক পা দুই পা করে অনেক দূর। আর কয়েক পা হাঁটতেই শৌখিন অবিশ্বাস্য ভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল সানজুর চোখের সামনে। সানজুর হাত থেকে ছাতা, কদম পড়ে গেল। সানজুর ডান হাত আপনা থেকেই মুখ উঠে আসলো। সানজুর হাত কাঁপতে লাগলো। শুধু হাত না সর্বাঙ্গ কাঁপতে শুরু করলো। সানজু ডুকরে কেঁদে উঠলো। কো... কো...কোথায় গেল শৌখিন? রাস্তা শূন্য কেন? কোথায় সে?
ধীরে ধীরে চারদিক আলোকিত হয়ে উঠছে।।সানজু এগিয়ে চলছে ঘরের দিকে। বৃষ্টি থেমে গেছে। সানজু মনমরা ভাবে হেঁটে চলেছে। একহাতে কদম আর অন্য হাতে ভেজা অগোছালো বন্ধ ছাতা। এতক্ষণে বাড়ির সবাই উঠে গেছে। যে যার কাজে ছুটছে। সানজু সকলের চোখের আড়ালে নিজের ঘরে প্রবেশ করলো। কদম গুলো টেবিলের উপর রাখলো পরম যত্নে। ছাতাটা ফেলে রাখলো ফ্লোরের উপর। রুমের এক পাশে রাখা পাখির খাঁচার দিকে এগিয়ে গেল। খাঁচাটা তুলে নিলো হাতে। তারপর নিজের রুম থেকে বের হলো। সবার দৃষ্টির আড়ালে ছাদে উঠে আসলো। ছাদে পানি জমে আছে। সানজু রেলিংয়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। খাঁচাটা রেলিংয়ের উপর ধরে রেখে খাঁচার মুখ খুলে দিলো। চারটা পাখি সুযোগ পেয়ে উড়ে গেল মুক্ত পানে।
___________
মন্টু ঘুম থেকে উঠেই শৌখিনকে খুঁজল। কিন্তু পাওয়া গেল না শৌখিনকে। মন্টু বাড়ির সবার কাছে জিজ্ঞেস করলো, শৌখিনকে দেখেছে কি না। কিন্তু কেউই দেখেনি। সানজুর কাছে জিজ্ঞেস করলে সে শুধু না সূচক মাথা নেড়েছিল। তারপর রুমে এসে ভীষণ কেঁদেছে। মুখে ওড়না গুঁজেও কেঁদেছে।
সাবের সাহেব যখন শুনলেন শৌখিনকে পাওয়া যাচ্ছে না, তখনই বুঝতে পারলেন শৌখিনকে আর পাওয়া যাবে না। ছেলেটা শেষমেষ সেই রহস্যের জাল জড়িয়ে রেখেই চলে গেল! সাবের সাহেব মনে মনে বুঝতে পারলেও, মুখে কাউকে কিছু বললো না।
শৌখিনকে খুঁজে না পেয়ে মন্টুর দিশেহারা অবস্থা। এক মুহূর্তও কোথায় বসে থাকতে পারছে না সে।
চাঁদনীও হতভম্ব হয়ে গেছে। হঠাৎ করে কোথায় চলে গেছে লোকটা? তবে কী...
মুহূর্তেই চাঁদনী একটা জিনিস বেশ বুঝতে পারলো। শৌখিনের হঠাৎ করে আসা, আবার নিখোঁজ হওয়া, আর এ কদিন ধরে সানজুর যে অবস্থা দেখেছে, তাতে হিসেব একদম মিলে গেছে। রূপকথার ছেলেটা আসলে, রূপকথা ছিল না। আর ওটা কোন গল্পও ছিল না। যেটা ছিল, সেটা ছিল তাহলে বাস্তব। এমনও হতে পারে? কীভাবে সম্ভব?
________________
[পাঁচ বছর পর]
ঢাকার শান্ত একটি গলি। এমনিতেও খুব বেশি মানুষের চলাচল নজরে পড়ে না এখানে। তার উপর আজকে আবার বৃষ্টি। মানুষের চলাচল খুবই কম। কয়েকটা গাড়ি আসা যাওয়া করছে। এখন আষাঢ়ের শুরুর দিক। সারাদিন টিপ টিপ করে বৃষ্টি লেগেই থাকে। একটা তিন তলা বাসার, দ্বিতীয় তলায় দাঁড়িয়ে আছে সানজু। তার উদাসী চোখের দৃষ্টি পিচ ঢালা রাস্তার পানে। বৃষ্টির অজস্র ফোঁটা রাস্তায় পড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। ব্যালকনির রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানো সানজু। বৃষ্টির পানি হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে বারান্দায়। ভিজছে সানজু। ভিজুক। কী আসে যায় তাতে? জ্বর আসবে? আসুক। এখন আর এসব জ্বর টরে কিছু আসে যায় না সানজুর। এই পাঁচ বছরে কত জ্বর এলো গেল!
গত পাঁচটি বছর কত কষ্ট দায়ক ছিল সানজুর জন্য, তা কেবল সানজুই জানে। পাঁচটি বছরকে পাঁচ যুগের সমান মনে হয়েছে তার কাছে। একেকটা দিন এত দীর্ঘ ছিল যে, মনে হয়েছে একটা জীবন শেষ হয়ে যাবে, এই একটা দিনের সাথে।
এই পাঁচটি বছরে পাঁচটা আষাঢ় অতিবাহিত করেছে সে। একেকটা আষাঢ় কত বেদনার, কত প্রতীক্ষার, কত হাহাকারের ছিল তা কেবল সানজুই জানে। হাজারটা আষাঢ় অপেক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে শৌখিনকে! কিন্তু এখন বুঝছে হাজারটা আষাঢ় নয়, একটা আষাঢ়ের একটা দিনের এক মুহূর্ত পার করা তার জন্য কত নির্মম যন্ত্রণার!
কী দরকার এই বৃষ্টি নামার? যেই বৃষ্টিতে শৌখিনের বিচরণ নেই, সেই বৃষ্টি নামার কী দরকার? কোনো দরকার নেই। নিঃশেষ হয়ে যাক এই আষাঢ়, আর এই বৃষ্টি। পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক বৃষ্টি নামক জিনিসটি। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক...
শৌখিনের জন্য সানজুর মনে জমে আছে অভিমান। শৌখিনের জন্য তার অনুভূতি কতটা গাঢ় সেটা শুধু শৌখিন চলে যাওয়ার পরেই বুঝেছে সে। আর অভিমানের হিসাবও কষতে শিখে গেছে খুব ভালো ভাবে। শৌখিনের প্রতি অভিমান শুধু এই কারণে যে, শৌখিন তার নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। সে আসবে বলে কথা দিয়েও এখনও আসেনি। যখন সে আসবে বলেই কথা দিলো, তখন কেন আসছে না? কেন এই অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ করছে?
সানজুর নয়ন দুটি ভিজে উঠলো। ঝাপসা হয়ে গেল চোখের দৃষ্টি। আর সেই ঝাপসা চোখের দৃষ্টিতে ফুঁটে উঠলো একটা চিরচেনা মুখ। সানজুর দৃষ্টি সচকিত হয়ে উঠলো। সে ঝুঁকে পড়লো রেলিংয়ের উপর। বৃষ্টির পানি সরাসরি মাথায় পড়ছে। সানজুর চোখের দৃষ্টি অস্থির ভাবে এদিক ওদিক ছুটছে। হন্নে হয়ে খুঁজছে। বুকের ভিতর অশান্ত ছটফটানি শুরু হলো। কোথায় গেল লোকটা? এই মাত্রই তো এখানে দেখতে পেয়েছিল! নিমেষে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল? সানজু যতদূর চোখ যায় সর্বত্র খুঁজলো। কিন্তু সেই চিরচেনা, অতিপ্রিয় মুখ ওয়ালা লোকটিকে আর চোখে পড়লো না। সানজু দৌঁড়ে ব্যালকনি থেকে নিচে যাওয়ার জন্য ছুটছে। একটু আগে যা দেখলো মন বলছে তা মিথ্যা হতে পারে না। কিছুতেই মিথ্যা না। সানজু মনে হাজারও উৎকণ্ঠা, আকাঙ্ক্ষা, অস্থিরতা নিয়ে ছুটছে। এটা কি স্বপ্ন? না কি বাস্তব? না কি স্বপ্নময় বাস্তব? সানজুর চোখ থেকে একের পর এক অশ্রু বিসর্জন হচ্ছে। এটা অবশ্যই বাস্তব! এটা বাস্তব হতেই হবে।
সানজু কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাস্তায় নেমে এলো। তীব্র বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে সানজু দ্রুত চোখের দৃষ্টি ঘোরাতে লাগলো সবখানে। এদিক থেকে ওদিক ছুটে প্রতিটা দোকানের ভিতরও খুঁজলো কিন্তু...কোথাও পেল না সেই প্রিয় মুখের ব্যক্তিটিকে।
সানজু রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের বুক কালো হয়ে বৃষ্টি ঝরিয়েই যাচ্ছে অঝর ধারায়। সানজুর বুক দ্রুত ওঠানামা করছে। ঘন শ্বাস পড়ছে। ভেজা ছোট ছোট চুল গুলো মুখের উপর পড়েছে এসে। সানজু মাথা নিচু করে হাঁফাচ্ছে। চারপাশ শূন্য। আর সেই শূন্যতা যেন উপহাস করছে সানজুকে। সানজুর চোখকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে চাইছে সেই উপহাস। কিন্তু না, কিছুতেই ভুল হতে পারে না। সে দেখেছে, সে অবশ্যই দেখেছে শৌখিনকে! ওই মুখ চিনতে তার কী করে ভুল হতে পারে? না এটা ভুল ছিল না। কিছুতেই ভুল ছিল না।
কিন্তু, সত্যিই শৌখিন হলে, গেল কোথায় সে? সত্যিই কি ওটা শৌখিন ছিল? না কি শূন্যতার এই উপহাসই সত্য? শৌখিন স্বপ্ন ছিল? না কি, অবিশ্বাস্য সত্য? সানজুর মনে একটা আশার প্রদীপ নিভতে নিভতেও জ্বলে উঠছে। নিভু নিভু করেও জ্বলছে সেটা।
সানজুর কণ্ঠ অস্পষ্ট, কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো,
"সত্যিই কি আমাদের আবার আষাঢ়ে দেখা হবে?"
সমাপ্ত
0 মন্তব্যসমূহ